বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবায় রোগীর সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের গুরুত্ব
উন্নত স্বাস্থ্যসেবা কি কেবল চিকিৎসকের দক্ষতায়? রোগীর ভাষা, সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও পারিবারিক বাস্তবতা বোঝাও জরুরি—এটি আস্থা বাড়ায়, সম্পর্ক গড়ে তোলে, চিকিৎসাকে করে পরিপূর্ণ।
Healing isn’t just clinical—it’s cultural. When patients’ beliefs, family backgrounds, and regional norms are overlooked, even the best treatments may fall short. This piece unpacks the missing link of cultural sensitivity as essential in medical practice.
নানা জাতি, ভাষা, ধর্ম ও আঞ্চলিক পরিচয়ের বুননে গঠিত বাংলাদেশ একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ ও সমৃদ্ধ দেশ। এই বৈচিত্র্য যেমন আমাদের শক্তি, তেমনি ন্যায়সঙ্গত ও কার্যকর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জও বটে। দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতা, ভাষা ও ধর্মীয় আচার-বিশ্বাস অঞ্চলভেদে ভিন্ন হওয়ায় স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে চিকিৎসকদের সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা ও নম্রতা জরুরি হয়ে ওঠে। রোগীর ভাষা, বিশ্বাস ও পারিবারিক প্রেক্ষাপট বোঝাপড়া চিকিৎসকদের প্রতি আস্থা তৈরি করে, কাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্যচর্চা গড়ে তোলে, চিকিৎসার মান বাড়ায় এবং রোগী-চিকিৎসক সম্পর্ককে গভীর করে। কেননা, একজন রোগী কোথায়, কীভাবে চিকিৎসা নেবেন, কিংবা আদৌ চিকিৎসা নেবেন কিনা—তা নির্ভর করে তার সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আচার-বিশ্বাস এবং সামাজিক বাস্তবতার ওপর।
অনেক রোগী আধুনিক বায়োমেডিকেল চিকিৎসার পাশাপাশি বা তার বদলে প্রথাগত স্বাস্থ্যচর্চা অনুসরণ করেন। স্থানীয় নিরাময়কারীদের ওপর ভরসা রাখেন। চিকিৎসা নেয়া বা না নেয়ার সিদ্ধান্তে পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং ধর্মীয় বিধিনিষেধের বড় প্রভাব থাকে। অনেক সময় রোগের উপসর্গ কীভাবে অনুভব ও প্রকাশ করবেন, সেটিও নির্ধারিত হয় ধর্মীয় বিশ্বাস ও আধ্যাত্মিক ব্যাখা দ্বারা। ফলে রোগী এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, যা আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্গে সবসময় মেলে না। কিন্তু এসব বিশ্বাস ও প্রথা তাকে মানসিক স্বস্তি দেয়। এ কারণে কার্যকর চিকিৎসা শুধু দক্ষতায় নয়, চিকিৎসকের সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা এবং রোগীর সঙ্গে সম্মানজনক যোগাযোগের উপরও নির্ভর করে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবায় কেন এবং কীভাবে সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা ডাক্তার-রোগীর মধ্যে কার্যকর যোগাযোগ ও আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলে—এই প্রবন্ধে তারই নানা দিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা ও বিনয়
চিকিৎসা ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা বলতে বোঝায়, রোগীর সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও পারিবারিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীর সচেতনতা ও সম্মানবোধ। এতে গুরুত্বপূর্ণ হলো—রোগী কীভাবে অসুস্থতা বোঝে, তার চিকিৎসা নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি কেমন, পরিবারের মতামতের গুরুত্ব কতটা, এবং সে চিকিৎসকের সঙ্গে কেমনভাবে যোগাযোগ করতে স্বচ্ছন্দবোধ করে—এসব বিষয় ভালোভাবে বোঝা ও বিবেচনায় নেওয়া। এই বোঝাপড়ার ভিত্তিতে চিকিৎসা পরিকল্পনা তৈরি করলে সেবা আরও কার্যকর হয়। বাংলাদেশে এমন সংবেদনশীলতা নিছক ভালো কোনো গুণ নয়, এটি নৈতিক ও কার্যকর স্বাস্থ্যসেবার জন্য একেবারে প্রয়োজনীয়। কারণ, স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার বিষয় এবং রোগী-চিকিৎসকের সম্পর্ক গভীরভাবে প্রভাবিত হয় নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতা দিয়ে—যেগুলো বোঝা এবং সম্মানের সঙ্গে মোকাবিলা করাই হলো সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা।
চিকিৎসা পরিবেশে ডাক্তার-রোগীর মধ্যে ক্ষমতার সম্পর্ক, লিঙ্গ পরিচয় ও সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য বড় ভূমিকা রাখে। তাই রোগীর চিকিৎসা নিতে যেসব সাংস্কৃতিক বিশ্বাস, অভ্যাস ও পারিবারিক প্রভাব কাজ করে, সেগুলো বুঝে চিকিৎসা পরিকল্পনা করা—এটাই সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা। এই সংবেদনশীলতা তিনটি স্তরে কাজ করে: ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও নীতিমালার ক্ষেত্রে। ব্যক্তি পর্যায়ে এটি ডাক্তার, নার্স বা স্বাস্থ্যকর্মীর মানবিকতা, নৈতিকতা ও সাংস্কৃতিক জ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রতিষ্ঠানিক পর্যায়ে, কোনো হাসপাতাল বা স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য, মূল্যবোধ ও সেবাদানের পদ্ধতিতে সাংস্কৃতিক অন্তর্ভুক্তির গুরুত্ব বোঝায়। আর নীতিগতভাবে, এটি এমন স্বাস্থ্যনীতি তৈরির দিকে ইঙ্গিত করে, যেখানে সমতা, ন্যায় ও বৈচিত্র্যের প্রতি সম্মান থাকে।
চিকিৎসায় শুধু সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা নয়, সাংস্কৃতিক বিনয় বা নম্রতাও গুরুত্বপূর্ণ। সংবেদনশীলতা মানে হলো—ভিন্ন সংস্কৃতি, আচরণ ও বিশ্বাস সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং সেগুলোকে সম্মান করা। তবে সাংস্কৃতিক বিনয় এক ধাপ এগিয়ে—এটি শুধু সচেতন থাকা নয়, বরং অন্য সংস্কৃতির মানুষের কাছ থেকে শেখার মানসিকতা রাখাকে বোঝায়। সংবেদনশীলতা অনেক সময় পরোক্ষ হতে পারে, কিন্তু বিনয় হলো সক্রিয় এক মানসিকতা। সংবেদনশীলতা প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার মাধ্যমে শেখা যায়, আর সাংস্কৃতিক বিনয় গড়ে ওঠে আত্ম-অনুভব ও নিজের সীমাবদ্ধতা বোঝার ক্ষমতা থেকে।
সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা মানে হলো—রোগীর সংস্কৃতি, বিশ্বাস, প্রথা ও মূল্যবোধ সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং সেগুলোর প্রতি সম্মান দেখানো। এটা বোঝা জরুরি যে, রোগীর স্বাস্থ্য সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি তার সাংস্কৃতিক পটভূমি দ্বারা গঠিত হয়। তাই চিকিৎসা পরিকল্পনায় রোগীর ধর্মীয় রীতি, খাবার সংক্রান্ত নিয়ম বা লজ্জাবোধের মতো বিষয়গুলোকেও গুরুত্ব দিতে হয়। কোনো রোগী ইংরেজি না জানলে বা শিক্ষিত না হলে সহায়তা দেওয়া, শারীরিক পরীক্ষায় অস্বস্তি বোধ করলে সম্মান দেখানো—এগুলো সংবেদনশীলতারই উদাহরণ।
অন্যদিকে, সাংস্কৃতিক বিনয় মানে হলো—নিজের দৃষ্টিভঙ্গি ও পক্ষপাত সম্পর্কে সচেতন থাকা, অন্য সংস্কৃতি থেকে শেখার মানসিকতা রাখা এবং রোগীকে তার অভিজ্ঞতার বিশেষজ্ঞ হিসেবে দেখা। চিকিৎসককে জানতে হবে রোগীর পরিবার কতটা ভূমিকা রাখতে চায়, বিকল্প চিকিৎসা নিয়ে রোগীর মত কী—এভাবে খোলামেলা সংলাপ গড়তে হবে। তাই বলা যায়, সংবেদনশীলতা হলো ভিন্নতার প্রতি সম্মান, আর বিনয় হলো সেই ভিন্নতার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে কাজ করার মানসিকতা। চিকিৎসায় এই দুই গুণ একসঙ্গে থাকলে রোগীর আস্থা বাড়ে, যোগাযোগ উন্নত হয় এবং স্বাস্থ্যসেবায় সমতা নিশ্চিত হয়।
বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট চিকিৎসায় সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা ও নম্রতা
বাংলাদেশের চিকিৎসায় সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা কেন গুরুত্বপূর্ণ—এই প্রশ্ন দিয়ে আলোচনা শুরু করা যাক। কারণ, স্বাস্থ্যসেবা শুধু রোগ নিরাময়ের বিষয় নয়, বরং পুরো ব্যবস্থাটাকেই আরও মানবিক ও কার্যকরভাবে গড়ে তোলার বিষয়। আমাদের সমাজে চিকিৎসা বিষয়ক অনেক সিদ্ধান্ত রোগী একা নেন না; বরং পরিবারই বড় ভূমিকা রাখে। কিন্তু অনেক চিকিৎসক এই পারিবারিক ভূমিকা বুঝে ওঠেন না। অথচ যদি চিকিৎসক রোগীর পরিবারকে বোঝেন এবং সঙ্গে রাখেন, তাহলে সেটি চিকিৎসার ক্ষেত্রে শক্তিশালী সহযোগী হতে পারে।
উপজেলা বা গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক শুধু রোগ নিরাময় করেন না, স্থানীয় মানুষের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কও গড়ে তোলেন। তাই সেই মানুষের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে ধারণা রাখা জরুরি। যেমন, কেউ রমজানে ওষুধ খেতে চান না, কেউ মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে খোলামেলা কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করেন—এগুলো শুধু চিকিৎসার সীমাবদ্ধতা নয়, বরং সাংস্কৃতিক চ্যালেঞ্জও। এ অবস্থায় চিকিৎসকের উচিত বিশ্বাসকে সম্মান করে এমন সৃজনশীল সমাধান খুঁজে বের করা, যা রোগীর পক্ষে গ্রহণযোগ্য হয়।
এরপর আসে ভাষা ও যোগাযোগের বিষয়। বাংলাদেশে ভাষাগত বৈচিত্র্য অনেক, ফলে ডাক্তার-রোগীর মাঝে অনেক সময় ভুল বোঝাবুঝি হয়। চিকিৎসকের কথা রোগী বুঝতে পারেন না, আবার রোগীর কথাও অনেক সময় চিকিৎসকের কাছে অস্পষ্ট থেকে যায়। সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা শুধু ভাষা জানার বিষয় নয়—এতে স্থানীয় ভাষা, শারীরিক ভাষা বা অঙ্গ-ইঙ্গিত, এবং সাংস্কৃতিক রীতিনীতিও বোঝার দরকার হয়, যা অঞ্চলভেদে ভিন্ন হতে পারে। অনেক সময় রোগী এমন চিকিৎসা পরিকল্পনায় রাজি হন, যা পরে মেনে চলতে পারেন না।
সচেতন চিকিৎসক বুঝেন, শুধু সেরা ওষুধ লিখে দিলেই যথেষ্ট নয়। কখনো এমন বিকল্প খুঁজে দিতে হয়, যা রোগী সাংস্কৃতিকভাবে সহজে গ্রহণ করতে পারেন। এই বোঝাপড়াই চিকিৎসা সফল হবে কিনা তা নির্ধারণ করে। মানুষের মধ্যে চিকিৎসকদের প্রতি আস্থাও একেকজনের একেক রকম হয়, আর সেটা শুধু ক্লিনিক্যাল দক্ষতা নয়, বরং চিকিৎসকের সাংস্কৃতিক বোঝাপড়া ও সম্মান দেখানোর ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। তাই সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা শুধু অতিরিক্ত গুণ নয়, বরং চিকিৎসার মৌলিক দক্ষতা। আমাদের মেডিকেল শিক্ষায় এই দক্ষতা শেখানো উচিত, হাসপাতালের কাজেও এটি গুরুত্ব পেতে হবে। চিকিৎসকদের উচিত এটি বোঝা—সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা হলো তাদের চিকিৎসার এক অপরিহার্য সরঞ্জাম।
বাংলাদেশের জটিল সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে একজন চিকিৎসকের সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা শুধু ভালো চিকিৎসা দেওয়ার বিষয় নয়—এটি স্বাস্থ্যসেবা সবার কাছে পৌঁছানোর প্রশ্ন। একজন দক্ষ চিকিৎসকের শুধু চিকিৎসা জ্ঞান থাকলেই হবে না, সেই জ্ঞানকে বাস্তবতায় প্রয়োগ করতে সাংস্কৃতিকভাবে সংবেদনশীলও হতে হবে। তবেই আমরা এমন একটি স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারব, যা দেশের প্রতিটি নাগরিককে তার বিশ্বাস, ঐতিহ্য বা সংস্কার নির্বিশেষে সেবা দিতে সক্ষম হবে।
যখন স্বাস্থ্যসেবা রোগীর সংস্কৃতিকে সম্মান করে দেওয়া হয়, তখন রোগী চিকিৎসকের ওপর আরও আস্থা রাখে, পরামর্শগুলো মেনে চলে, এবং নির্ভয়ে চিকিৎসা নেয়। এর ফলে শুধু চিকিৎসার ফলাফল ভালো হয় না, রোগী-চিকিৎসকের সম্পর্কও মজবুত হয়। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য এটি আরও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তারা নানা কারণে চিকিৎসা নিতে ভয় পায় বা পিছিয়ে পড়ে। যদি চিকিৎসক তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বুঝে চিকিৎসা দেন, তাহলে স্বাস্থ্যসেবায় সমতা নিশ্চিত হয়, রোগীর সন্তুষ্টি বাড়ে, আর বৈষম্য কমে। সব মিলিয়ে এতে দেশের জনস্বাস্থ্যও উন্নত হয়।
বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা খুবই জরুরি, কারণ এটি ঐতিহ্যবাহী ও আধুনিক চিকিৎসার মাঝে একটি সেতুবন্ধ তৈরি করতে সাহায্য করে। ধর্মীয় বিশ্বাস, সামাজিক রীতিনীতি, লিঙ্গভিত্তিক ভূমিকা, আর্থ-সামাজিক বৈষম্য—এসব বিষয় রোগী-চিকিৎসকের সম্পর্ক এবং চিকিৎসা গ্রহণে বড় প্রভাব ফেলে।
তাই সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা মানে শুধু ভিন্ন সংস্কৃতি মেনে নেওয়া নয়, বরং রোগীর যেসব বিশ্বাস, অভ্যাস ও সামাজিক বাস্তবতা তার স্বাস্থ্য বিষয়ে ধারণা গড়ে তোলে—তাদের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা দেখানো। এজন্য চিকিৎসকদের নিজেদের সাংস্কৃতিক পক্ষপাত ও ধারণাগুলো নিয়েও ভাবতে হবে এবং এমনভাবে কাজ করতে হবে যাতে সেবা হয় ন্যায্য, সহজলভ্য ও রোগীকেন্দ্রিক।
সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা মানে হলো—ধর্ম, জাতিসত্তা, লিঙ্গ, আর্থ-সামাজিক অবস্থা বা আঞ্চলিক পটভূমি যেভাবে একজন রোগীর আচরণ ও চিকিৎসা গ্রহণে প্রভাব ফেলে, তা বোঝা এবং সেই অনুযায়ী সাড়া দেওয়া। এটি কেবল পরিচয়ের পার্থক্য বোঝা নয়, বরং প্রতিটি রোগীকে তার নিজস্ব সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে বুঝে, সাধারণীকরণ না করে, আন্তরিকভাবে সেবা দেওয়া।
চিকিৎসার ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা সরাসরি রোগীর জীবন ও সুস্থতার সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের হাসপাতালে চিকিৎসকদের নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়। অনেক সময় দেখা যায়, একজন বৃদ্ধ রোগী পরিবারের সহায়তা নিয়ে হাসপাতালে আসেন, কিন্তু কিছু ওষুধ নিতে অস্বীকার করেন—কারণ সেগুলোতে এমন উপাদান থাকতে পারে যা তার ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে যায় না। এসব বাস্তবতা বুঝে চিকিৎসা দিতে পারাই সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতার মূল চর্চা।
মেডিকেল কলেজের ক্লাস, বইপত্র ও হাসপাতাল ভবিষ্যৎ চিকিৎসকদের ক্লিনিক্যাল দিক থেকে দক্ষ করে তোলে, কিন্তু বাস্তব সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির জন্য তারা প্রস্তুত থাকেন না। বাংলাদেশে ডাক্তার ও রোগীর মধ্যে একটি শক্তিশালী ক্ষমতার সম্পর্ক আছে, যা লিঙ্গ ও আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের সঙ্গে জড়িত। সাধারণত চিকিৎসক থাকেন এই সম্পর্কের শীর্ষে, আর রোগীরা নিচে। এই পার্থক্য আরও বড় হয় যখন রোগী দরিদ্র, অশিক্ষিত বা সমাজের প্রান্তিক অংশের কেউ হন। এতে করে তারা ভয়ে কথা বলতে পারেন না বা তাদের কথা গুরুত্ব পায় না।
নারী রোগীদের জন্য পরিস্থিতি আরও কঠিন। তাদের অনেক সময় চিকিৎসা নিতে পুরুষ আত্মীয়ের অনুমতি লাগে, কিংবা কারও সঙ্গ ছাড়া চিকিৎসকের কাছে যেতেই পারেন না। এর ফলে চিকিৎসা বিলম্ব হয়, অনেক সময় প্রয়োজনীয় সেবাও পান না। দরিদ্র ও কম শিক্ষিত মানুষ চিকিৎসা সম্পর্কে তথ্য, সুযোগ ও বিকল্প থেকে বঞ্চিত থাকেন। বিশেষ করে সরকারি হাসপাতালে, চিকিৎসা চলাকালীন তাদেরকে বৈষম্যের মুখে পড়তে হয়—যা ডাক্তার ও রোগীর সম্পর্ক এবং চিকিৎসার গুণমান—দুটোই প্রভাবিত করে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা দিতে গিয়ে চিকিৎসক ও নার্সদের রোগী এবং তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়। এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে ভাষাগত, ধর্মীয়, জাতিগত, আঞ্চলিক এবং আর্থ-সামাজিক পার্থক্য। রোগী যদি আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন বা সাংস্কৃতিকভাবে আলাদা পরিভাষা ব্যবহার করেন, তাহলে অনেক সময় চিকিৎসার নির্দেশনা ঠিকভাবে বোঝাতে বা বুঝতে সমস্যা হয়।
এছাড়া ইশারা-ইঙ্গিত বা পরোক্ষভাবে কথা বলার মতো যোগাযোগের ধরনও ভুল বোঝাবুঝির কারণ হতে পারে, কারণ এসব প্রকাশভঙ্গি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নিয়মে গঠিত। তাই এসব জটিলতা সামলাতে চিকিৎসকদের স্থানীয় ভাষা ও সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গ বুঝতে হবে, এবং বিভিন্ন পটভূমির মানুষের সঙ্গে সহানুভূতিশীল ও প্রাসঙ্গিকভাবে যোগাযোগ করার দক্ষতা গড়ে তুলতে হবে।
স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের সাংস্কৃতিক দক্ষতা ও সংবেদনশীলতা বিকাশে করণীয়
স্বাস্থ্যসেবায় সাংস্কৃতিক দক্ষতা ও সংবেদনশীলতা এখন সময়ের চাহিদা। এজন্য চিকিৎসা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। এ জন্য দরকার একটি সমন্বিত পরিকল্পনা—যার মধ্যে থাকবে পাঠ্যক্রমে সাংস্কৃতিক বিষয় যুক্ত করা, অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা, রোগী-কেন্দ্রিক কেস স্টাডি, ভূমিকা পালন বা সিমুলেশন, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, আন্তঃপেশাগত শিক্ষা এবং নিয়মিত পেশাগত উন্নয়ন।
মেডিকেল শিক্ষায় শুরু থেকেই সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য নিয়ে আলাদা মডিউল থাকা উচিত—যেখানে ধর্ম, অঞ্চল ও জাতিগত প্রভাব কীভাবে স্বাস্থ্যচর্চায় ভূমিকা রাখে, তা শেখানো হবে। শিক্ষার্থীদের মাঠপর্যায়ে যেমন গ্রামীণ ক্লিনিক বা কমিউনিটি হেলথ প্রজেক্টে কাজের সুযোগ দিতে হবে, যাতে তারা বাস্তব সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বুঝতে পারে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ভুল বোঝাবুঝি তুলে ধরতে কেস স্টাডি ব্যবহার করে সমালোচনামূলক চিন্তা ও আলোচনা উৎসাহিত করা যেতে পারে।
অনুশীলনভিত্তিক শিক্ষা—যেমন ভূমিকা পালন বা সিমুলেশন—শিক্ষার্থীদের নিরাপদ পরিবেশে বিভিন্ন সংস্কৃতির রোগীদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার দক্ষতা তৈরি করতে সাহায্য করে। একই সঙ্গে, শিক্ষকদেরও সাংস্কৃতিক প্রশিক্ষণ নিতে হবে যাতে তারা এসব দক্ষতা শিক্ষার্থীদের শেখাতে পারেন। তাই ফ্যাকাল্টি ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামে সাংস্কৃতিক সচেতনতা, পক্ষপাত চিহ্নিতকরণ এবং সংবেদনশীল শিক্ষণ পদ্ধতির উপর জোর দেওয়া প্রয়োজন।
About the Author:
মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম
সিনিয়র লেকচারার, মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব)। শিক্ষকতা শুরুর আগে তিনি দ্য ডেইলি স্টার, ঢাকা ট্রিবিউন, ডেইলি সান এবং ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশনে সাংবাদিকতা করেছেন। তার গবেষণার প্রধান ক্ষেত্রগুলো হলো: স্বাস্থ্যসেবায় যোগাযোগ, পাবলিক হেলথ কমিউনিকেশন, বায়ো-এথিকস, বায়ো-কমিউনিকেবিলিটি, সোশ্যাল নিউরোসায়েন্স এবং সোশ্যাল নেটওয়ার্ক অ্যানালাইসিস। লেখকের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ইমেইল করুন এই ঠিকানায়: aminul.vu@gmail.com