৫ আগস্টের বিপ্লব বনাম ৯০-এর সুবিধাভোগী নেতৃত্ব: বিএনপির বাস্তবতা
বিএনপিতে ব্যক্তি পূজার রাজনীতির ফলে ত্যাগী ও তরুণ নেতারা কোণঠাসা। ৫ আগস্টের বিপ্লবের পর পুরাতন সুবিধাভোগীরা পুনরায় কর্তৃত্ব কায়েম করায় হতাশা ও ক্ষোভ বৃদ্ধি পেয়েছে।
This article critiques the growing cult of personality in BNP politics, which sidelines young and dedicated activists. Following the August 2024 uprising, old-guard leaders have reclaimed power, frustrating grassroots supporters and risking internal divisions. The writer urges BNP’s high command to retire failed, opportunistic leadership before further damage occurs.
বর্তমান সময়ে বিএনপির সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ করেছে 'ব্যক্তি পূজারি' রাজনীতি। তৃণমূলে ব্যক্তির জয়গানের রাজনীতিতে সয়লাব। তরুণ প্রজন্মের রাজনীতিকরা কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। বিএনপির কিছু হেভিওয়েট নেতার আচরণে বিগত ত্যাগী ও পরিশ্রমী কর্মীরা চরম হতাশ। জুলাই-আগস্টে তাদের ন্যূনতম ভূমিকা ছিল না, অথচ গণঅভ্যুত্থানের পর তারাই হয়ে উঠেছেন বেপরোয়া। এই বাস্তবতায় অনেক ত্যাগী নেতাকর্মী রাজনীতি ছাড়ার প্রতিজ্ঞা করছেন। ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে যারা জীবনবাজি রেখে রাজপথে ছিলেন, তারাই আজ বড় বড় নেতাদের চোখের বিষ। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী কিছু নেতার অপরিপক্ব আচরণের কারণে ২০২৪ সালের বিপ্লবীরা ইতিহাস থেকে মুছে যেতে বসেছে।
বিএনপিতে ১৯৯০ স্বৈরাচার এবং ২০২৪ সালের ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে ছায়া লড়াই শুরু হয়েছে। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, ১৯৯০ প্রজন্মের ভীতরে আধিপত্য এবং কর্তৃত্ববাদী মানসিকতার ছাপ স্পষ্ট। এটি অস্বীকার করবার কোন সুযোগ নেই যে, জীবনবাজী রেখে তৎকালীন স্বৈরাচার এরশাদকে পতন ঘটিয়েছিলেন আমাদের বর্তমান সিনিয়র রাজনীতিকরা। যার ফলে সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হয় বাংলাদেশ। অন্যদিকে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট ছিলো বিগত দীর্ঘ ১৭ বছরের হাসিনার অপশাসনের চূড়ান্ত পরিণতির ফল। গুলি উপেক্ষা করে ছাত্র-জনতা দেড় হাজার তাজা রক্তের বিনিময় ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে বিদায় করে। এজন্যই ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের আগের এবং পরের প্রজন্ম কখনোই আধিপত্যবাদ বা কর্তৃত্ববাদকে সমর্থন করে না। করবার প্রশ্নই আসে না।
জাতীয়তাবাদী শক্তির আদর্শের বাতিঘর স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান (বীর উত্তম), গণতন্ত্রের মাতা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আর ফ্যাসিবাদী অপশাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ী বীর সেনানি জনাব তারেক রহমানকে নিয়েই আবর্তিত বিএনপির রাজনীতি। অথচ তৃণমূলে উপরোক্ত তিনজনের চেয়ে স্ব স্ব অঞ্চলের রাজনৈতিক প্রতিযোগীর অভাবে ব্যক্তি পার্টির আর্বিভাব ঘটেছে। এটি করেছে বেশি সিনিয়র নেতৃত্ব। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের পরিবর্তে লোকাল নেতার গুনগান করে দলের ইমেজ নষ্ট করা হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে বিএনপি। বরং বিএনপির উচিত তিনশো সংসদীয় আসনে কমপক্ষে ৯শ প্রতিযোগী প্রস্তুত রাখা। সবার আগে নিজদলের ভীতরে সুস্থ রাজনৈতিক চর্চা নিশ্চিত করা।
এই বাস্তবতা বুঝতে হলে বিএনপির নেতৃত্ব কাঠামো বিশ্লেষণ জরুরি। দলটিতে বর্তমানে মূলত তিনটি প্রজন্মের রাজনীতিকরা বেশ সক্রিয়-শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান প্রজন্ম, বেগম খালেদা জিয়া প্রজন্ম এবং তারেক রহমান প্রজন্ম। এর মধ্যে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১৯৯০ সালে এরশাদ পতনের পর যারা সক্রিয় হন, তারা দীর্ঘ সময় বিএনপির কর্তৃত্বে থেকেছেন। এই প্রজন্মের নেতাদের বড় একটি অংশ ১৯৯১-১৯৯৬ ও ২০০১-২০০৬ সময়ে চরম সুবিধাভোগী ছিলেন। জিয়াউর রহমান প্রজন্ম বয়সের ভারে ন্যুব্জ, আর খালেদা জিয়া প্রজন্মের নেতারা ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছেন পুরনো রাজনীতির ধারা এবং আধিপত্য নিয়ে। ফলে ২০০৭ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত রাজপথে থাকা তারেক রহমান প্রজন্মের ত্যাগী নেতাকর্মীরা দিন দিন কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন।
বেগম জিয়ার প্রজন্ম এখনো তারেক রহমান প্রজন্মকে রাজনীতির যথার্থ স্পেস দিচ্ছেন না। এক কথায় তরুণ প্রজন্ম বিএনপিতে এখনো উপেক্ষিত। অথচ ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারিতে জরুরি সরকার ক্ষমতা দখলের পর থেকেই মূল সংগ্রামের নেতৃত্ব দেন ছাত্রদল-যুবদল-কর্মীরা। তারেক রহমানের গ্রেফতারের (৭ মার্চ ২০০৭) পর জরুরি আইনের ভেতরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম মিছিল বের করে ছাত্রদল। বিএনপির বড় বড় নেতা তখন কেউ কারাগারে, কেউ সংস্কারপন্থী হয়ে বাইরে, কেউ আবার সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে রাজনীতিকে স্থবির করে ফেলেন।
সন্তানদের ভবিষ্যৎ ও নিজের ব্যবসা রক্ষায় তখন অনেকেই আপোষ করেন। যার ফলে শুরুতে সরকারবিরোধী রাজনীতিতে বারবার হোঁচট খেতে হয় বিএনপিকে। তবে খন্দকার দেলোয়ার হোসেন, হান্নান শাহ, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শুরু থেকেই মাঠে সক্রিয় থাকেন। ২০১৮ সালে বেগম খালেদা জিয়ার কারাবরণের পর বিএনপির নিয়ন্ত্রণ কার্যত তারেক রহমানের হাতে চলে আসে। এরপর তরুণ নেতৃত্ব এক নতুন উদ্দীপনায় রাজপথে সক্রিয় হয়।
২৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সী এই তারেক রহমান প্রজন্ম জীবন বাজি রেখে রাজপথে যুদ্ধ করে গেছেন। তারেক রহমান দল পুনর্গঠনে সরাসরি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবকদলসহ প্রতিটি অঙ্গসংগঠনের কাঠামো ঢেলে সাজান। প্রতিটি পর্যায়ের কর্মীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপন করেন। যার ফসল আমরা দেখেছি ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলনে। ওই আন্দোলনে প্রতিটি অঙ্গসংগঠনকে স্পষ্টভাবে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন তিনি। ছাত্রদলের সুপার ফাইভসহ নির্ধারিত নেতাদের নির্দিষ্ট দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয়, এবং তারা সেসব দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করেন। ইন্টারনেট বন্ধ থাকলেও বিশেষ দূতের মাধ্যমে আন্দোলনের সবস্তরের কর্মীদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখেন তারেক রহমান। সাংবাদিক, শিক্ষক, পেশাজীবীদের সঙ্গেও নিয়মিত মতবিনিময় করেন তিনি। তার নেতৃত্বে ছাত্র-জনতার বিপ্লবে শেখ হাসিনা দেশত্যাগে বাধ্য হন।
৫ই আগস্টের বিজয়ের পর জনমানুষের মধ্যে বিএনপির প্রতি আস্থা ও প্রত্যাশা আরো বেড়ে যায়। কিন্তু পুরনো সুবিধাভোগী, আন্দোলনে অনুপস্থিত নেতাদের ক্ষমতা পুনরুদ্ধার সেই আস্থায় ধাক্কা দেয়। যাঁরা ১৯৯০ সালে ছাত্রনেতা ছিলেন, পরে এমপি হন, মন্ত্রী হন, আন্দোলনে নিষ্কিয় ছিলেন তারাই এখন ত্যাগী কর্মীদের এক প্রকার কোণঠাসা করে ফেলেছেন। অনেকেই ২০০৭ সালের পর আর রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। কেউ কেউ সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে বা পলায়নপর থেকে সময় পার করেছেন। কেউ বা ছিলেন লম্বা সময় জেলে। রাজপথে ছিলেন কেবল কয়েকজন: দেলোয়ার হোসেন, হান্নান শাহ, মির্জা ফখরুল, রুহুল কবির রিজভীরা। বাকিরা নিজ অবস্থান টিকিয়ে রাখতে কর্মসূচিতে হাজিরা দিয়েই সীমাবদ্ধ ছিলেন। মুক্ত বাতাসে ফিরে বিএনপির ওইসব পুরাতন নেতৃত্ব বাস্তবভিত্তিক রাজনীতির সাথে খাপ খাওয়াতে পারছেন না।
তারেক রহমানের নেতৃত্ব গ্রহণের পরও এদের অনেকে নিষ্ক্রিয় থাকেন। ভোটের নামে প্রহসনের পর ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের রাতেই ত্যাগী কর্মীদের সঙ্গে এই নেতাদের সংযোগ ছিন্ন হয়। অথচ ২০২৪ সালের বিপ্লবের পর হাসিনা হটানো আন্দোলনের অগ্রভাগের কর্মীরা যখন প্রতিদান পাওয়ার আশায় ছিলেন, তখন ওই পুরনো, পরিত্যক্ত নেতারা ফের দলে প্রভাব খাটিয়ে আগের মতোই স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছেন। বিরূপ আচরণ, পরিবারকেন্দ্রিক অপকর্ম, দখলবাজি ও দুর্নীতিতে তারা আবারও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। যে সব ফ্যাসিস্টের হাতে ত্যাগী নেতারা নির্যাতিত হয়েছেন, সেই ফ্যাসিস্টদেরই এখন আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন বর্তমান নেতারা। ফলে রাজনীতির মাঠে যে হতাশার চিত্র তৈরি হয়েছে, তা সহজেই দৃশ্যমান।
দলীয় পদ আঁকড়ে থাকা এই নেতাদের অতীত অবদান বা রাজনৈতিক মর্যাদা এখন আর মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। পুরাতন আধিপত্য এবং কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি জুলাই-আগস্ট বিপ্লবী এবং জনগনের কাছে অগ্রহনযোগ্য। এই রাজনীতি পরিতাজ্য। বিএনপির হাইকমান্ডের এখনই উচিত-এই অপদার্থ ও আপোষকৃত নেতৃত্বকে অবসরে পাঠানো। না হলে বিগত দিনের মতোই দল আবারও ক্ষতির মুখে পড়বে।
About the Author:
Saidur Rahman is a political analyst and Political & Election Affairs Editor at The Daily Ittefaq.
Disclaimer: The views expressed in this article are the author's own and do not necessarily reflect The Insighta's editorial stance. However, any errors in the stated facts or figures may be corrected if supported by verifiable evidence.