'তৌহিদী জনতা' কারা, পেছনের রহস্য কি?
২০১৪ সালে রাজনৈতিক কৌশল থেকে উঠে আসা 'তৌহিদী জনতা' এখন ক্ষমতার সমীকরণে বড় শক্তি। আওয়ামী লীগের দ্বৈত নীতি ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিস্তারে এ গোষ্ঠী আরও প্রভাবশালী, যা নতুন সরকারকেও চ্যালেঞ্জে ফেলবে।
A decade-old political strategy has turned “Tawhidi Janata” into a decisive force, shaping the electoral landscape in Bangladesh. As parties navigate religion, identity, and cultural tensions, this mobilized constituency now stands at the center of power equations, posing complex challenges that the next government cannot ignore.
সম্প্রতি মানিকগঞ্জে ধর্ম অবমাননা ও কটূক্তির অভিযোগে আবুল সরকার নামে এক বাউলশিল্পীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২৩ নভেম্বর ওই বাউলশিল্পীর সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান ‘তৌহিদী জনতা’ ব্যানারে একদল মানুষ। এতে দু’পক্ষের অন্তত চারজন আহত হয়। এ ঘটনার পর তৌহিদী জনতা ইস্যুতে নতুন করে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। দৈনিক সমকাল পত্রিকার সিনিয়র রিপোর্টার রাজিব আহাম্মদ ২৪ নভেম্বর এক ফেইসবুক পোস্টে এ বিষয়ে একটি বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা তুলে ধরেছেন। তার মতে, আওয়ামী লীগবিরোধী শক্তি হিসেবে পরিচিত বিএনপি-জামায়াতকে কোনঠাসা করতে ২০১৪ সালে পরিকল্পিতভাবে তৌহিদী জনতার উত্থান ঘটনা হয়েছিল। রাজিব আহাম্মদের লেখাটি কিছুটা পরিমার্জন করে ইনসাইটা’র পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো।
‘তৌহিদি জনতা’ নামের যে শক্তি; এটার শুরু আসলে ২০১৪ সালে। বিএনপি ও জামায়াতকে কোনঠাসা করতে পরিকল্পিতভাবে এটার উত্থান ঘটানো হয়েছিল। আগামী সরকারকেও সমস্যা পোহাতে হবে। কারণ শেখ হাসিনা ধর্ম এবং ইসলামোফোবিয়ার দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতি সমাজে তৈরি করে গেছেন, তা দূর করা সহজ নয়। এটাকে মব বলে চালিয়ে দিয়ে সমাধান হবে না।
ব্যাপারটা খোলাসা করে বলি। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বয়ানের ওপরের পর্দা মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মনিরপেক্ষতা হলেও এর ভেতরে রয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানকে কাল্টে পরিণত করা, ভারতপন্থি নীতি এবং আদর্শিক শ্রেষ্ঠত্ববাদ।
বিএনপির রাজনৈতিক বয়ানের মুখ বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ। জাতীয়তবাদের ভেতরে রয়েছে ভারতবিরোধিতা, আওয়ামী বিরোধিতা। ধর্মীয় মূল্যবোধের আউটার শেলের ভেতরে রয়েছে, মুসলিম আইডেন্টিটি (ইসলামিক নয়)।
জামায়াতের রাজনৈতিক বয়ান ইসলামী সমাজ (এখন অবশ্য ইনসাফের সমাজ হয়েছে)। ইসলামী সমাজের এই বয়ানের ভেতরের স্তরে রয়েছে ভারত বিরোধিতা, ইসলামিক জাতীয়তাবাদ।
২০১৩ সালের শাপলা গণহত্যা এবং ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার পক্ষে মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মনিরপেক্ষতায় টেকা মুশকিল ছিল। তিনি বিএনপিকে দুর্বল করতে ইসলামিক ভাবাবেগের সমর্থন নিজের পক্ষে টানা শুরু করেন। মদিনা সনদে দেশ চালানোর আলাপ দেন। ২০১৩ সালে যে হেফাজতকে পিটিয়ে ভর্তা বানিয়েছিলেন, সেই কওমিপন্থিদের কাছে টানেন।
ইসলামী আন্দোলনসহ নানা শক্তিকে আওয়ামী লীগ স্পেস দিয়েছিল, জামায়াতকে দুর্বল করতে। কওমি অঙ্গনে জামায়াতের স্টেক নেই; দেওবন্দ এবং মওদুদী আর্দশের বিরোধে। দেওবন্দি স্কুল থটে মওদুদী মুসলমানই নন। তাই জিয়াউর রহমানের ধর্মীয় মূল্যবোধের রাজনীতির কারণে, বিএনপিই কওমি অঙ্গনে রাজনৈতিক মিত্র-বন্ধু।
২০১৪ সাল থেকে শেখ হাসিনা দেওবন্দি ধারার ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে নিজেদের দিকে টানা শুরু করেন, ২০১৩ সালের মামলা ব্যবহার করেন। প্রথমে ইসলামী ঐক্যজোট, পরে খেলাফত, জমিয়তকে বিএনপির সঙ্গ ছাড়া করে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এই দলগুলো আওয়ামী লীগের জোটে না গেলেও, সরকারের ঘোর বিরোধিতা করেনি। বিএনপিকে দুর্বল করতে এ দলগুলো এবং হেফাজতকে আওয়ামী লীগ নরমে গরমে বশে রাখে। আবার ইসলামকে নিজের দিকে রাখে।
উত্থান ঘটে তৌহিদি জনতার। হেফাজত মুরব্বিরা গণভবনে গিয়ে শেখ হাসিনার প্রশংসা, সোহরাওয়ার্দীতে সমাবেশ করে কওমি জননী খেতাব দেওয়া ছিল ইসলামী ভাবাবেগকে আওয়ামী লীগের পক্ষে কব্জা করার অংশ। দেওবন্দি ধারা বিএনপির সমর্থন জিরো করতে, শেখ হাসিনা তাদের অনেক বাড়াবাড়িকে প্রশ্রয় দেন। এ থেকেই মিছিলের ব্যানারে তৌহিদি জনতার ব্যবহার শুরু হয়।
২০১৬ সালে দুনিয়া জুড়ে আইএস এবং কায়েদাদের রমরমার কারণেও, এগুলো ঠেকাতে শেখ হাসিনার তখন তৌহিদি জনতার সমর্থন প্রয়োজন ছিল। যাতে এই আন্তর্জাতিক উগ্রবাদীদের দেশীয় সমর্থকদের কঠোর দমন কোনোভাবে যাতে ইসলামের ওপর নিপীড়ন বলে সমাজে গণ্য না হয়।
কওমিধারার বাইরে যে ইসলামিক চিন্তা রয়েছে, তা জামায়াতের নিয়ন্ত্রণে। বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ, আলিয়া মাদ্রাসায় আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির সমান সমান প্রভাব জামায়াতের রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশি। বিএনপিকে মেরে তাড়ালেও, গুপ্ত রাজনীতির কারণে জামায়াতকে তাড়াতে পারেননি শেখ হাসিনা। তখন সরকারি গোয়েন্দারা চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলনকে বিনাবাধায় কাজ করার সুযোগ দেয় সর্বত্র।
২০১০ সালে মুক্তাঙ্গনের সমাবেশ ছাড়া পরের ১৪ বছরে কখনই ইসলামী আন্দোলনের কর্মসূচিতে পুলিশ, আওয়ামী লীগের হামলা হয়নি। ইসলামী আন্দোলন আওয়ামী লীগে যোগ দেয়নি। ডিলটা ছিল, জামায়াতকে নিশ্চিহ্ন করতে গিয়ে ইসলামী আন্দোলনকে মারধর করা হবে না, কাজে বাধা দেওয়া হবে না।
আওয়ামী লীগের পক্ষে বয়ান উৎপাদন করা শহুরে সাংস্কৃতিক অঙ্গন বামপন্থি এবং ক্ষেত্র বিশেষে ইসলামোফোবিক হলেও শেখ হাসিনা নিজেকে একইসঙ্গে একজন মুসলিম এবং লিবারেল নেতা হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন। যিনি জনসভায় বলতেন, “তাহাজ্জুদ, ফজরের নামাজ পড়ে আমি সকালের চা খাই।” আবার সাংস্কৃতিক সার্কেলে বলতেন, “আমি রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনতে শুনতে সকালের চা খাই।”
দুই নৌকায় পা দিয়ে চলার এই নীতিতে, দুইটা বিপরীতমুখী ঘটনা ঘটল। তৌহিদি জনতা বার্তা পেলো, কালাচারাল উইং আবার কী? আমরা যা চাই করব। আবার কালাচারাল উইং বার্তা পেলো, ওদের আবার আবেগ অনুভূতি কী? ওরা ঊনমানুষ। ওদের রুচি আমরা ঠিক করব। হোয়াইট ম্যানস’ বার্ডেন আরকি।
এ বিরোধে শেষদিন পর্যন্ত শেখ হাসিনাকে তৌহিদি জনতার কাছ থেকে শুনতে হয়েছে, আওয়ামী লীগ বাম ও ইসলামোফোবিকদের দল। এবং কালচারাল উইংয়ের কাছ থেকে শুনতে হয়েছে, আওয়ামী লীগ মৌলবাদীদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।
ক্ষমতায় অন্ততকাল থাকতে শেখ হাসিনার নেওয়া এই কৌশল দেশের ক্ষতি করেছে, আওয়ামী লীগের ক্ষতি করেছে। শেখ হাসিনার সময়ে দেশে মসজিদ মাদ্রাসা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। নাইন ইলাভেন পরবর্তী দুনিয়ায় মুসলিম পরিচয়ের কারণে হয়রানী ও আদারিং করায়, ইসলামিক আইডেনটিটি শক্তিশালী হয়েছে। শেখ হাসিনার ইসলামাইজেশন এবং দেওবন্দি শিক্ষার প্রসারে এরপর আওয়ামী লীগের আদর্শ মুসলমানদের কাছে প্রবলেমেটিক হয়ে যায়।
আমি আওয়ামী লীগের এমন একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা এমপিকে পেয়েছি, যারা শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যকে মূর্তিই মনে করেন। সাংস্কৃতিক অঙ্গন যতই একে শিল্প বলুক, তাদের কাছে এটা পাপ। শেখ মুজিবের প্রতিকৃতিতে ফুল দেওয়া শিরক বলেই তারা বিশ্বাস করেন। তারা আমাকে বলেছেন, মুসলমান হিসেবে এগুলো মেনে নিতে পারছেন না।
কাল্ট পলিটিক্স করতে গিয়ে শেখ হাসিনা এটাকে অব্যহত রাখেন। যার ফল হল, গ্রামের চাষাভুষা মানুষ নতুন তৈরি মসজিদে দাওরায়ে হাদিস পাস করা খতিবের কাছ থেকে জানল, কাল্ট পলিটিক্স গুনাহ। তাই বিশ্বাসী মুসলমানদের বড় অংশ আওয়ামী লীগের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। তাদের গন্তব্য হয়ে উঠে চরমোনাইয়ের পীরের দল। দেখবেন, গত এক দশকে ইসলামী আন্দোলনের যত কর্মী বৃদ্ধি পেয়েছে অধিকাংশ আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলেন। অনেকে জামায়াতে গিয়েছেন।
বিএনপি করার সুবিধা হল, জিয়াউর রহমানকে পুজনীয় করে তোলার কিছু নেই। জিয়াউর রহমানের মাজারে ফুল না দিয়েও বিএনপি করা যায়। আর বাসায় ছবি লাগানোর তো দরকারই নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগ করতে হলে, শেখ মুজিবের প্রতিকৃতিতে ফুল দিতেই হবে, ছবি লাগাতেই হবে।
এই দ্বন্দ্ব আওয়ামী লীগকে একদিকে দুর্বল করেছে। এবং শেখ হাসিনার নীতি সহায়তায় গড়ে উঠা তৌহিদি জনতাকে ক্ষুব্ধ করেছে।
এদেশে মাজার, যাত্রা, পালাগান, বাউল গান নিয়ে সবসময়ই সমাজের একাংশে আপত্তি ছিল। এটা নতুন নয়। ৬০ বছরের আগে সিনেমাতেও দেখবেন, বাউলকে চুল কেটে দেওয়া হচ্ছে। ২৮ বছর আগে আওয়ামী লীগের শামীম ওসমান পতিতা পল্লী উচ্ছেদ করেছে। ইসলামাইজেশনের ফলে এখন মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে হচ্ছে, কারণ তৌহিদি জনতার ব্যানার দায়মুক্তির পথ করে দিয়েছে। এ কারণে আওয়ামী লীগ আমলে এক বাউলের পিঠকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করা হলেও কিছু হয়নি। এখন সমালোচনা বেশি কারণ, আওয়ামী লীগ এবং তাদের কালচারাল উইং দেখাতে চায়, ৫ আগস্টে অভ্যুত্থান নয় উগ্রবাদের উত্থান হয়েছে। বাউলকে জেলে দেওয়া এ বয়ানকে সুট করে।
এই যেমন দেখুন, মানিকগঞ্জের ঘটনার পর এত কথা হলেও, এই তৌহিদি জনতা কারা তা চিহ্নিত করতে আগ্রহ নেই। অথচ সবার চেহারা ভিডিওতে আছে। কিন্তু চিহ্নিত করা করা হবে না। কারণ, তৌহিদি জনতাকে নির্বাচনে লাগবে।
হেফাজত আমির প্রায় প্রতিদিন বয়ানে জামায়াতকে কাদিয়ানির চেয়ে খারাপ বলছেন। নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিএনপির জন্য এই বক্তব্য সুবিধাজনক। দেওবন্দি ধারাকে ভোটে পাশে লাগবে; কারণ বিএনপির ধর্মীয় মূল্যবোধ এবারের আট দলের ইসলামী ঐক্যের বয়ানের সামনে দুর্বল। আর ভারত বিরোধী সবাই-ই।
সে কারণেই হেফাজত আমির ও অন্যান্য উলামারা আকিদ্বা প্রশ্নে ধুয়ে দিলেও জামায়াত নির্বাচন পর্যন্ত কিছু বলবে না। মানিকগঞ্জের ঘটনায় কারা কারা জড়িত তা নিয়ে মুখ খুলবে না। কারণ, জামায়াতেরও লক্ষ্য হল নির্বাচনের আগে কওমি দেওবন্দি আরও বেশি ক্ষেপানো যাবে না। তাই জামায়াত আমির ফেসবুকে লিখে নেতাকর্মীদের সাবধান করেছেন; কেউ যাতে আলেম-উলামাদের সমালোচনা না করেন।
নির্বাচনের মাঠের এই সমীকরণ তৌহিদি জনতার দায়মুক্তির পথ আরও প্রশস্ত করেছে। দলগুলোর শহুরে নেতাকর্মীরা ফেসবুকে একটু উহু আহা করলেও, এর বেশি কিছু ঘটবে না। কারণ, ১১ বছরে যে সিলসিলা তৈরি হয়েছে, নির্বাচনের আগে এটার বিরুদ্ধে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ।
শেষ কথা হল, শহুরে সাংস্কৃতিক অঙ্গনকেও হোয়াইট বার্ডেন চিন্তা থেকে বের হতে হবে। জঙ্গী, বর্বর বলে গালাগালি করে বাউল কার্ড খেললে পরিস্থিতির অবনতিই হবে। ধর্ম শুধু বিশ্বাস নয়, আশ্রয়ও। ওইখানে অযথা হাত দিয়েন না। আশ্রয় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, এটা যত বেশি মনে করবে, তত ক্ষেপবে। ফেসবুকে গালাগালি আর বিবৃতি এই সমস্যার সমাধান নয়। সমাধান হল আলোচনা, পরস্পরকে জানা। এর মাধ্যমে দায়মুক্তির পথ বন্ধ হবে। আইন আদালত দিয়েও এর সমাধান নেই।
About the Author
Rajib Ahamod is a Bangladeshi journalist. He has been working for the daily Samakal since 2009. His areas of work include politics, political analysis, human rights, labor protection, and infrastructure development.
Disclaimer: The views expressed in this article are the author’s own and do not necessarily reflect The Insighta’s editorial stance. However, any errors in the stated facts or figures may be corrected if supported by verifiable evidence.



