ক্যাম্পাস থেকে ক্ষমতার করিডর: ধর্ষণকে টিকিয়ে রাখে কারা
বাংলাদেশে আলোচিত ধর্ষণগুলোতে স্পষ্টভাবে উঠে আসে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবশালীদের ভূমিকা। ক্ষমতা, প্রভাব আর বিচারহীনতার সংস্কৃতি ধর্ষণকে নিয়মিত করে তুলেছে, ভুক্তভোগীরা থেকেছেন উপেক্ষিত।
In Bangladesh, rape often reflects a demonstration of power than individual crime. From Sohagi Jahan Tonu’s unresolved murder in Cumilla to widely reported assaults at Sylhet MC College, Subarnachar, and Jahangirnagar, recurring allegations point to perpetrators’ ties with ruling political networks and student groups, encouraging impunity and entrenched influence.
ধর্ষণ বাংলাদেশে আর কেবল ব্যক্তিগত অপরাধ নয়; এটি ক্ষমতার প্রদর্শনী। কুমিল্লার তনু হত্যার রহস্য আড়াল থেকে শুরু করে সিলেট এমসি কলেজ, নোয়াখালীর সুবর্ণচর কিংবা জাহাঙ্গীরনগরের সাম্প্রতিক ধর্ষণ—প্রায় প্রতিটি ঘটনার পেছনে ছিল ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতারা বা সামাজিক-রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। কেউ ছিলেন প্রভাবশালী ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের উত্তরসূরি, কেউ ছিলেন স্থানীয় শাসক দলের চিহ্নিত ক্যাডার। বিচার বিলম্ব, রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় আর সামাজিক কলঙ্কের ভয়ে অধিকাংশ মামলাই ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ফলে ধর্ষণ পরিণত হয়েছে এক অচলায়তনে, যেখানে অপরাধীর পরিচয় যত বড়, তার রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনাও তত বেশি।
বাংলাদেশে আলোচিত কিছু ধর্ষনের ঘটনা :
সিলেট এমসি কলেজে তরুণী ধর্ষণ
২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় সিলেটের ঐতিহ্যবাহী মুরারিচাঁদ কলেজের (এমসি কলেজ) সামনে ঘুরতে যায় এক নবদম্পতি। গেটের সামনে থেকে স্বামীর সামনেই স্ত্রীকে তুলে নিয়ে যায় প্রভাবশালী কয়েকজন। ঘণ্টাখানেক পর এলাকাবাসীর সহায়তায় কলেজের ছাত্রাবাসের একটি কক্ষ থেকে বিধ্বস্ত অবস্থায় নিজের স্ত্রীকে উদ্ধার করেন তিনি। পরে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, তার স্ত্রীকে যখন জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় তখন দুই ব্যক্তি স্বামীকে গাড়িতে আটকে রাখে। এই ঘটনায় এমসি কলেজ ছাত্রলীগের আট নেতা-কর্মীকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে অভিযোগ গঠন করে সিলেটের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। পরে মামলার কোন অগ্রগতি না হওয়ায় ভুক্তভোগী তরুণীর স্বামী হাইকোর্টে একটি রিট করেন। ওই বছরেরই ১৫ই ডিসেম্বর মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বদলির আদেশ দেয় হাইকোর্ট। প্রায় আড়াই বছর পর চলতি ২০২৫ সালের মে মাসে মামলাটি নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনাল থেকে সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর হয়ে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। সাক্ষ্য গ্রহণ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত মামলার বাদী ভুক্তভোগীসহ চারজন সাক্ষ্য দিয়েছেন।
জাহাঙ্গীরনগরে আলোচিত ধর্ষণের ঘটনা
দেশের নানা আন্দোলন-সংগ্রামে সবসময় অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। বিশেষ করে নারী অধিকার ও প্রতিবাদের প্রশ্নে এ ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা আপোষহীন। ১৯৯৮ সালে জাবি ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জসিমউদ্দিন মানিক এ ক্যাম্পাসেই এক দুঃসাহসী কাজ করেন। সেসময় দলীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে তিনি ক্যাম্পাসে ১০০-এর অধিক নারীকে ধর্ষণ করে তা উদযাপন করেছিলেন বলে কথিত আছে। ফলশ্রুতিতে তার নাম হয়ে যায় ‘সেঞ্চুরি মানিক’। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি সংখ্যাটা আরো কম বলে দেখতে পেয়েছিল। পরে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে তাকে বহিষ্কার করা হয়।
২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে সময়ের সবচেয়ে বেশি আলোচিত ধর্ষণের ঘটনা ঘটে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। মীর মোশররফ হোসেন হলের ‘এ’ ব্লকের ৩১৭ নাম্বার কক্ষে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে বোটানিক্যাল গার্ডেনে নিয়ে ধর্ষণ করে শাখা ছাত্রলীগের তিন নেতা কর্মী। এ ঘটনায় জড়িত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্র ও শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান, একই বিভাগের সাগর সিদ্দিকী ও হাসানুজ্জামান এবং উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সাব্বির হাসান এবং ছাত্রলীগের সহসম্পাদক মুরাদ হোসেন।
পরে বিচারের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় উত্তাল হয়ে উঠলে অভিযুক্তদের বহিষ্কার ও তিনজনকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আর আন্দোলনের মুখে চাকরিচ্যুত হন পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান জনি। তার বিরুদ্ধে নিজ বিভাগের একাধিক নারী শিক্ষার্থীর সাথে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের অভিযোগ ছিলো। তিনি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৬ ব্যাচের শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি।
কুমিল্লায় তনু হত্যা
কুমিল্লা সেনানিবাসের একটি বাসায় গৃহশিক্ষিকা ছিলেন সোহাগী জাহান তনু। সেই বাসার পার্শ্ববর্তী জঙ্গল থেকে তার মরদেহ পাওয়া যায় ২০১৬ সালের ২০শে মার্চ। পরদিন বিকেলে তনুর বাবা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহকারী ইয়ার হোসেন বাদী হয়ে কোতোয়ালী থানায় মামলা করেন। পুলিশ ধারণা করেছিলো, তাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। অনুমান নিশ্চিত হওয়ার জন্য দুই দফায় ময়নাতদন্ত করা হয়। প্রথম ময়না তদন্তের প্রতিবেদনে ধর্ষণের কোনও আলামত পাওয়া যায়নি এবং তনুর মারা যাওয়ার কারণও সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। পরে তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি জানায়, নিহত তনুর শরীর থেকে নেওয়া নমুনার ডিএনএ পরীক্ষা করে ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে। সবশেষ ২০২০ সালের ২১শে অক্টোবর মামলাটি সিআইডি থেকে পিবিআই-এর কাছে হস্তান্তর করা হয়। তনু হত্যার বিচার দাবিতে শিক্ষার্থী, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন জোরালো আন্দোলন করলেও বিচার এখনো আলোর মুখ দেখেনি।
নোয়াখালিতে আলোচিত দুই গৃহবধূ ধর্ষণের ঘটনা
২০২০ সালের ২রা সেপ্টেম্বর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার একটি গ্রামে এক গৃহবধূর বাড়িতে ঢুকে তাকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করে স্থানীয় কয়েকজন যুবক। এ সময় গৃহবধূর স্বামীকে পাশের একটি ঘরে আটকে রাখে ওই যুবকরা। গৃহবধূকে নির্যাতনের সে ঘটনার ভিডিও করে রাখা হয়। এক মাস পরে সামাজিক মাধ্যমে তা ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়। এ ঘটনায় জড়িত ৯ জনের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ও পর্ণোগ্রাফি আইনে পৃথক দু’টি মামলা করেন ওই নারী। বিচারে ২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হলেও আসামিরা উচ্চ আদালতে আপিল করেছে।
নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন রাতে স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদের দ্বারা দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এক নারী। তার অপরাধ একটাই- নৌকায় ভোট না দেয়া। সেদিন রাতেই এ ঘটনার ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় ১০ অভিযুক্তকে মৃত্যুদণ্ড ও ছয় জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন নোয়াখালীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ২। ২০২৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারী এ রায় ঘোষণা করা হয়।
মুনিয়ার আত্মহত্যা ও বসুন্ধরার আলোচিত এমডি আনভীর
২০২১ সালের ২৬ শে এপ্রিল গুলশানের একটি ফ্ল্যাটে কলেজছাত্রী মুনিয়ার মৃতদেহ দেখতে পেয়ে পুলিশে খবর দেন তার বোন। সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলছিলো মোসারাত জাহান মুনিয়ার মৃতদেহ। বোনের দাবি ও পুলিশের তদন্তের সূত্রে জানা যায়, মুনিয়ার সাথে বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরের যোগাযোগ ছিল। এ ফ্ল্যাটে নিয়মিত যাওয়া-আসা ছিলো আনভীরের। মুনিয়ার আত্মহত্যার ঘটনায় আনভীরের প্ররোচনার অভিযোগ উঠলেও তাকে অব্যাহতি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় পিবিআই। পুলিশ জানায়, তাদের তদন্তে ধর্ষণ বা হত্যার অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি।
আলোচিত আরো কিছু ধর্ষনের ঘটনা
২০২২ সালের ২১ জানুয়ারি গোপালগঞ্জের মকসুদপুর উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নঈম কাজীর নেতৃত্বে ৪ জন এক তরুণীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে। মামলার দেড় মাস পর পুলিশ ছাত্রলীগ নেতাকে গ্রেপ্তার করলেও ওই মামলায় এখনো চার্জশিট হয়নি বলে জানা গেছে। একই বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি সাভার সদর থানা ছাত্রলীগের সভাপতি সোহেল রানা এক কিশোরীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে। তার বিরুদ্ধে মামলা হলে ৪ দিন পর র্যাব তাকে গ্রেপ্তার করে।
২০২৪ সালের ১৪ জানুয়ারি বাগেরহাটের ফফিরহাটে উপজেলা সদর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি শাকিল আহমেদ ও তার সহযোগীরা দুই তরুণীকে রাস্তা থেকে অপহরণ করে নিয়ে ধর্ষণ করে। পরে শাকিলকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারলেও তার সহযোগীরা পলাতক।
এছাড়া ২০২৩ সালের ২৫ জুন রংপুরের পীরগঞ্জে এক গৃহবধুকে জিম্মি করে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ইয়াসিন আরাফাতের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় শুভর বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা দায়ের করা হয়। তবে মামলা হওয়ার পর থেকে পলাতক এই ছাত্রলীগ নেতা।
২০১৯ সালে রংপুরের হারাগাছ এলাকায় এক স্কু ল-ছাত্রীকে ধর্ষণের পর তার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ ওঠে ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাসেল মিয়ার বিরুদ্ধে। পরে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ের পরিস্থিতি
২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে পুরনো রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ভেঙে পড়ার পর রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা ধর্ষণের ঘটনা কমে আসার কথা ছিলো। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সারাদেশে ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ৪০১ জন নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৩৪ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন সাতজন। ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছেন ১০৯ জন। এর মধ্যে একজনকে ধর্ষণচেষ্টার পর হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া ২০২৪ সালে ২১ জন নারী গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসেই ৪৯২টি ধর্ষণ আর ১৭২ জনকে ধর্ষণচেষ্টার খবর গণমাধ্যমে এসেছে। এর মধ্যে ২৪ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে আর ছয়জন আত্মহত্যা করেছেন। আর ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছেন অন্তত ১৭২ জন।
এমন বাস্তবতায় ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মামলার ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন পরিবর্তন করার কথা জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। মামলার তদন্তের সময় ৩০ দিন থেকে কমিয়ে ১৫ দিন করা হচ্ছে। ধর্ষণের মামলায় ৯০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করার বাধ্যবাধ্যকতা রাখা হচ্ছে।
ধর্ষণের পরিসংখ্যান একেবারে ছোট নয়
বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, বাংলাদেশে গত ১০ বছরে সাড়ে ৯ হাজারের বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, এর মধ্যে ২ হাজারের বেশি সংঘবদ্ধ ধর্ষণ। দেশে সবচেয়ে বেশি, ১ হাজার ৬২৭টি ধর্ষণ হয়েছে ২০২০ সালে। সেবছর দেশে করোনা মহামারি শুরু হয়। ২০১৩ সাল থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এই সময়ে দেশে ৯ হাজার ৬৫৫টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২ হাজার ৩৭৯টি সংঘবদ্ধ ধর্ষণ। তবে দেশে যে পরিমাণ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, সেই তুলনায় মামলা হয়েছে অনেক কম।
২০১৯ সালে ধর্ষণ হয়েছে ১ হাজার ৪১৩টি এবং এর মধ্যে মামলা হয়েছে ৯৯৯টি। ২০২০ সালে ধর্ষণ হয়েছে ১ হাজার ৬২৭টি এবং মামলা হয়েছে ১ হাজার ১৪০টি। ২০২১ সালে ১ হাজার ৩২১টি ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৯১৬টি। ২০২২ সালে দেশে ৭৩৪টি ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৫০৩টি। গত ১০ বছরে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৫৭২ জনকে এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ১০৩ জন।
এছাড়া জেলাভিত্তিক পরিসংখ্যানে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ঢাকায়। ২০২২ সালে ঢাকা জেলায় ৪৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। একই সময়ে নারায়ণগঞ্জে ৩৭টি, চট্টগ্রামে ২৭টি, গাজীপুরে ২২ ও নোয়াখালী জেলায় ১৫টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। আইনজীবী ফাহমিদা আক্তার জানান, দেশে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে। এছাড়া প্রেম করে নাবালিকাদের পালিয়ে যাওয়ার পর অভিভাবকেরা অপহরণ ও ধর্ষণের মামলা করছেন। বাংলাদেশ পুলিশের জনসংযোগ দপ্তরের সূত্রে জানা গেছে, ‘জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯’ নম্বরে ফোন করে অনেকে ধর্ষণের ঘটনা জানিয়ে সহায়তা চান। কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে পারিবারিক দ্বন্দ্বেও ধর্ষণের মতো অভিযোগ দেয়া নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাজেই মামলার সংখ্যা থেকে ধর্ষণের প্রকৃত পরিসংখ্যান জানা যায় না। এসবের আড়ালে ধর্ষণের বাস্তব ঘটনায়ও অনেকে অভিযোগ করতে সাহস করেন না।
ধর্ষণ প্রবণতা কোথা থেকে আসে?
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সাল বলেন, ‘এইরকম ধর্ষণের সাথে ক্ষমতার সম্পর্ক আছে। পুরুষ-শাসিত সমাজে পুরুষের ক্ষমতা চর্চার সুযোগ আছে। একই সাথে রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত থাকলে সাহস আরও বেড়ে যায়, বেপরোয়া হয়ে ওঠে। কোনো অপরাধ করলে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করে দায় এড়ানো হয়, কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তি হয় না। এমসি কলেজের ঘটনায় হয়নি। আরও অনেক ঘটনায় হয়নি। ফলে তারা বেপরোয়া হয়ে গেছে।’
এ বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘প্রত্যেক মানুষের মধ্যে ২টি প্রবৃত্তি থাকে। তার মধ্যে একটি হলো পাশবিক প্রবৃত্তি। যারা ধর্ষণ করেন, তারা এই পাশবিক প্রবৃত্তি দ্বারা চালিত হন। এটিকে কোনোভাবেই মানসিক সমস্যা বলার সুযোগ নেই।’ এছাড়া কর্মপরিবেশে মানুষের মধ্যে এক ধরনের একঘেয়েমি তৈরি হলে তাদের মধ্যে অনিশ্চয়তা কাজ করে। যা মানুষকে নানা অপরাধের দিকে প্ররোচিত করে। তাছাড়া, বিভিন্ন দুর্যোগের সময় এ ধরনের অপরাধ বেড়ে যায়।’
প্রভাবশালী বা ক্ষমতাসীনরাই কেন ধর্ষণে জড়িত থাকে?
স্বাভাবিক বিচারে ধর্ষণ হলো মানব চরিত্রের সর্বনিম্ন অধঃপতন। রাজনৈতিক প্রভাব, ব্যবসা বা অন্য কোন কারণে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা থেকে হয়তো ধর্ষণের মতো অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ে। এতে বিচারকে প্রভাবিত করার মানসিকতাও হয়তো তাকে সাহস জোগায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা বলেন, ‘ধর্ষণের সঙ্গে ক্ষমতার সম্পর্ক আছে। ধর্ষণের ক্ষেত্রে একজন পুরুষের জৈবিক চাহিদা পূরণের চেয়ে বেশি প্রাধান্য পায় তার শক্তি প্রদর্শনের চিন্তা। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা, নাগরিক অধিকার, সামাজিক সুরক্ষা-এসব কিছুর সঙ্গেও ধর্ষণের সম্পর্ক রয়েছে। যখন দেশে কোনো ধর্ষণের ঘটনা ঘটে তখনই ধর্ষণ নিয়ে আলোচনা হয়। এর বাইরে কোনো আলোচনা হয় না। মানুষের নৈতিক শিক্ষারও অভাব রয়েছে।’
আলোচিত হলেই বিচারের তোড়জোড়
সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার ভয়ে অনেকেই ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ্যে আনতে চান না। এজাতীয় কোন ঘটনা প্রকাশ পেলে উল্টো ভুক্তভোগীকেই সমাজ দোষীর চোখে দেখে। অনেক সময় তার ওপরই দোষ চাপিয়ে দেওয়া হয় এবং ধর্ষককে নিরপরাধী হিসেবে তুলে ধরা হয়। এক্ষেত্রে আমাদের বিচারব্যবস্থার ত্রুটিও লক্ষ্যণীয়। আদালতে ন্যায়বিচার পেতে অনেক ঝামেলার সম্মুখীন হতে হয়। এর সাথে যুক্ত হয় সামাজিক নানা বিধিনিষেধ, প্রথা, প্রভাব-প্রতিপত্তি। স্থানীয় পর্যায়ে বিচারে অনেক সময় ভুক্তভোগীকে ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এভাবে ধর্ষণকে একধরনের বৈধতা দেওয়া হয়। এর ফল হয় দীর্ঘমেয়াদী ও নেতিবাচক। সর্বোপরি, রাষ্ট্র তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারছে না বলেই দেশে বারবার ধর্ষণের মতো অপরাধের ঘটনা ঘটছে।
এ অনাচারের শেষ কোথায়?
ধর্ষণ রোধে মূল্যবোধের চর্চা জরুরি, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। অপরাধী যত প্রভাবশালী হোক, দ্রুত তদন্ত, সাক্ষী সুরক্ষা, সময়বদ্ধ বিচার, দলের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা এবং ক্যাম্পাস-রাজনীতি সংস্কার এখনই লাগবে। রাষ্ট্র ব্যবস্থা কাজ করলে অপরাধের পুনরাবৃত্তি থামবে, ভুক্তভোগী ন্যায়বিচার পাবেন, আর সমাজে এ বার্তা যাবে যে ক্ষমতা নয়, আইনই সর্বশেষ কথা।
About the Author
Noman Bin Harun is a Research Assistant at the International Crimes Tribunal (ICT-BD). He completed his LLB and LLM from Jahangirnagar University and worked as a campus journalist for almost five years. He can be reached at nomanbinharun02@gmail.com
Disclaimer: The views expressed in this article are the author's own and do not necessarily reflect The Insighta's editorial stance. However, any errors in the stated facts or figures may be corrected if supported by verifiable evidence.