তামিমের বিদায়বক্তব্যে ‘আইডল’ ও ‘ভক্ত’-দ্বন্দ্ব: ভক্তি নাকি বিভক্তির সংস্কৃতি?
ক্রিকেটার তামিম ইকবালের অবসরগ্রহণকালীন বক্তব্যে উঠে এলো ‘আইডল’ আর ‘ভক্ত’-এর দ্বন্দ্ব—ভক্তিই কি বিভক্তি আনছে? নাকি ক্রিকেটের রাজনীতিকরণেই জন্ম নিচ্ছে ‘তামিমিয়ান-সাকিবিয়ান’ সংস্কৃতি?
What happens when fandom fuels division instead of unity? This provocative essay unpacks Tamim Iqbal’s farewell speech to reveal the tensions between sports, idolization, and politicization in Bangladeshi cricket. Are “Tamimians” and “Sakibians” just loyal fans or symptoms of a deeper cultural fracture? Know how heroes fall, fanbases polarize, and the dressing room becomes a battleground.
‘এখানে কোনো তামিমিয়ান নেই, সাকিবিয়ান নেই, কোনো মাশরাফিয়ান নেই। সবাই বাংলাদেশের সমর্থক। এটা বাংলাদেশের ক্রিকেটকে ধ্বংস করেছে। দয়া করে এটা থামান।’ ‘আপনি আমার ভক্ত হতে পারেন, আপনি সাকিবের ভক্ত হতে পারেন, আপনি মাশরাফির ভক্ত হতে পারেন। কিন্তু আমরা যখন খেলি, আমরা বাংলাদেশের হয়ে খেলি। এটা বন্ধ করুন। এসব জিনিস তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংস করে।’
‘আমি আমার শেষ বার্তা হিসেবে এটাই বলতে চাই, আমরা সবাই বাংলাদেশি। আর কিছুই না। দয়া করে দলকে সমর্থন করুন। তারা অনেক তরুণ একটা দল। তারা ভুল করতে পারে। ব্যর্থ হতে পারে। কিন্তু এটা আপনাদেরই দল। সুতরাং একসাথে থাকুন। এখানে কোনো স্বতন্ত্র ব্যক্তি নেই। এখানে একটাই দল আছে, সেটা হলো বাংলাদেশ ক্রিকেট দল।’
গত ০৭ ফেব্রুয়ারি রাতে বাংলাদেশের প্রিমিয়ার লীগ (বিপিএল) ফাইনাল শেষে দেশের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার তামিম ইকবাল ভক্তদের উদ্দেশ্যে এই কথাগুলো বলেন। দীর্ঘ ১৭ বছরের ক্যারিয়ারের শেষে রাখা এমন বক্তব্য আপাতদৃষ্টে বেশ ইতিবাচক। কিন্তু প্রচ্ছন্নভাবে সেখানে কী ভক্তদের দোষারোপ করার সুর পাওয়া যায়? তামিম আসলে কোন শ্রেণীর ভক্তদের উদ্দেশ্যে এই কথাগুলো বলেছেন? পাঠকেরা একটু দ্বিধান্বিত হতে পারেন এই ভেবে যে, ভক্তদের মধ্যে আবার শ্রেণীবিন্যাস এলো কোথা থেকে!
আসুন, লিটল মাস্টার শচীন টেন্ডুলকারের ‘ঈশ্বর’ হওয়ার পেছনের কথা একটু জেনে নেই। ২০১১ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপের আগে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান ভিভিয়ান রিচার্ডস বলেছিলেন যে, আবেগগত কারণে এই ট্রফি ভারতের জেতা উচিত। একমাত্র এটার মাধ্যমেই টেন্ডুলকারকে যথাযথ সম্মান জানানো হবে, বলে তিনি উল্লেখ করেছিলেন। এমনকি যদি এর অর্থ তার নিজ দেশের ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানো হয়, তবুও তিনি ভারতেরই জয়ের পক্ষে ছিলেন।
সেইসময় তিনি টেন্ডুলকারকে ক্রিকেটের ‘ঈশ্বর’ বলে অভিহিত করেন। এটার ব্যাখ্যায় তিনি উল্লেখ করেছিলেন, টেন্ডুলকার ব্যাটসম্যান হিসেবে অনেক ভারতীয় ক্রিকেটারকে অনুপ্রাণিত করেছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি, ব্যাটসম্যানশিপের পরিমণ্ডলে তিনি ঈশ্বর। ...আমার মতে শচীন যা করেছেন... তিনি এমন একটি ভিত্তি তৈরি করেছেন যেখানে ভারতীয় দলের বাকিদের জন্য ব্যাটসম্যানশিপের পরিমণ্ডলটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে।’ অর্থাৎ, টেন্ডুলকার যে একজন ‘আইডল’ হয়ে আরও অনেক ব্যাটসম্যানদের অনুপ্রাণিত করেছেন এবং ব্যাটসম্যান হিসেবে গড়ে ওঠার ভিত্তিটা তৈরি করেছেন—এটা তিনি উল্লেখ করেছিলেন।
এই মন্তব্য থেকে আমরা দুইটা কনসেপ্ট পাই। এক, আইডল এবং দুই, ভক্ত। তাহলে এই ‘আইডল’ আর ‘ভক্ত’ এবং তামিমের ‘তামিমিয়ান’, ‘সাকিবিয়ান’, ‘মাশরাফিয়ান’ কী ভিন্ন ভিন্ন ধারণা?
‘তামিম’ বাংলাদেশের ক্রিকেটের সেরা উৎপাদন,
কিন্তু দেশের ক্রিকেট সংস্কৃতিতে তাঁর মনোগত প্রভাবও কী ততটাই?
আসুন, আমরা একটু পেছনে ফিরে যাই। ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর তামিম তার ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে তার এক ছোট ভক্তের লেখা চিঠি শেয়ার করে লেখেন, ‘আমি মনে করি, পৃথিবীতে ঈশ্বরের সৃষ্টির মধ্যে ক্রিকেট হলো সর্বশ্রেষ্ঠ একটা জিনিস। আর ক্রিকেটের ভক্তরাও তাদের দেশবাসীর চেয়েও একে অপরের সাথে অনেক বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ। আমার এই সুন্দর ভক্তদের জন্যই, আমরা খেলি।’
সেই ছোট ভক্ত ২০১৬ সালের নভেম্বরে কোনো এক শুক্রবার গোটা অক্ষরে পেনসিল দিয়ে ইংরেজিতে সেই চিঠিটা লেখেন। যার বাংলা অনুবাদ দাঁড়ায়, ‘প্রিয় তামিম ইকবাল, আমি তাদোয়ার ইয়াজদান শাইয়ান। তুমি বাংলাদেশের সেরা খেলোয়াড়। আমি তোমার মতো হতে চাই। আমি তোমার একজন বড় ভক্ত। তুমি কি আমার বন্ধু হবা? আমি তোমার মতো হতে চাই। আমরা কি লাঞ্চে দেখা করে একসাথে খাবার খেতে পারি? ভালোবাসা। তাদোয়ার।’
আবার ২০২৩ সালের এশিয়া কাপে ২৪ বছরের বামহাতি ব্যাটসম্যান তানজিদ হাসান তামিমের বাংলাদেশের জাতীয় দলে জায়গা পাওয়ার পর এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, ‘এটা আমার ডাকনাম (তামিম)। শৈশব থেকে তাঁর সাথে আমার তুলনার কথা শুনে আসছি।’ তামিমের সাথে তার তুলনা শুধু নামের জন্যই নয়, বরং তার ব্যাটিংয়ের ধরণটাও তামিমের মতোই—এমন প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘সত্য কথা হলো, আমি তাঁর খেলা দেখে বড় হয়েছি এবং তাঁর থেকেই অনুপ্রেরণা পেয়েছি।... তিনি আমার আইডল। আমি তাঁর থেকে অনেক কিছু শেখার চেষ্টা করি।’
প্রথমজন যিনি ‘তামিম ইকবাল’ হতে চান, দ্বিতীয়জন যিনি গড়ে উঠেছেন ‘তামিম ইকবাল’কে দেখে। এই যে মনোগত প্রভাব—এটা তামিম কতখানি রেখেছেন, কিংবা আদৌ কোনো প্রভাব রেখেছেন, নাকি তৈরি করেছেন অন্য কোনো সংস্কৃতি?
ড্রেসিংরুমে, দলে তৈরি হয়ে গেছে দলীয়করণের
রাজনীতি, তৈরি হয়েছে বিভাজন
যারা তামিমের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের উত্থান দেখেছেন, তারা জানেন তামিমের সাথে আরও একজন সমানভাবে উঠে এসেছেন—তিনি হলেন সাকিব আল হাসান। ২০০৬ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের দলে একসঙ্গে খেলেছিলেন। শোনা যায়, তখন থেকেই তাদের বন্ধুত্বের কথা। প্রথমে বন্ধুত্ব এবং ক্যারিয়ারের শেষের দিকে ঘোর শত্রু। এতটাই শত্রু যে তারা একে অপরের সাথে কথা পর্যন্ত বলেন না! এমনকি এটার জন্য দলের অন্য সবাইকে তাদের দুজনের সাথে বুঝে শুনে কথা বলতে হতো। কারণ একজনের সাথে কথা বললে আরেকজন না পাছে ভেবে বসেন যে, তিনি "তার দলের লোক"! অর্থাৎ, তাদের জন্য টীমে অজান্তেই এক ধরনের দলাদলি (গ্রুপিং) সৃষ্টি হয়েছিল।
কী কারণে তাদের সম্পর্কে এই অবনতি—এটার সুস্পষ্ট কোনো কারণ নেই। তবে ধারণা করা হয়, দুজন দুজনের সাফল্যে ঈর্ষাবোধ, কর্তৃপক্ষের গুরুত্ব পাওয়া-না-পাওয়ার মতো কারণে তাদের সম্পর্কে অবনতি ঘটে থাকতে পারে। এখন তামিম তার শেষ বার্তায় কী এটার জন্য ভক্তদের দায়ী করলেন?
আর একবার পেছনে ফিরে যাওয়া যাক। তামিম-সাকিব দ্বন্দ্ব সম্পর্কে প্রথম জানা যায়, ২০২০–২০২১ সালে কোভিড মহামারী চলাকালীন। এরপর ২০২৩ সালের বিশ্বকাপের দল ঘোষণার সময় তৎকালীন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের বক্তব্যের পর এটা মিডিয়ার সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেইসময় তিনি ক্রিকেট সংবাদ-সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইট ক্রিকেটবাজ-এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমকে ‘স্বাস্থ্যকর নয়’ বলে অভিহিত করেছিলেন। আর ড্রেসিংরুমের এই সংস্কৃতির জন্য তিনি তামিম-সাকিবের দ্বন্দ্বকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। এই দ্বন্দ্ব থেকেই কী ‘তামিমিয়ান’, ‘সাকিবিয়ান’ ভক্ত সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে?
রূপকথার ‘রাজকুমার’ থেকে আজকের ‘ইনফ্লুয়েন্সার’:
পরিবর্তিত মিডিয়া পরিবেশে নতুন অডিয়েন্স, নতুন আইডল
পৃথিবীতে সভ্যতা আসার পূর্ব থেকেই ‘আইডল’-এর ধারণার উদ্ভব ঘটে। রূপকথার গল্পগুলোর আবির্ভাবে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, প্রস্তর যুগ অর্থাৎ প্রাগৈতিহাসিক সময়কাল থেকেই এর অস্তিত্ব পৃথিবীতে বিদ্যমান ছিল। সেই সময় মানুষ কথা বলতে পারতো না। ভাষার উদ্ভব তখনও হয়নি। মানুষ গুহায় খোদাই করে দৈনন্দিন অভিজ্ঞতাগুলো ধারাবাহিকভাবে চিত্রের মতো করে অঙ্কন করতো। এটা তারা করতো তাদের সঙ্গী, সাথীদেরকে নির্দিষ্ট পরিস্থিতি, স্থান সম্পর্কে জানাতে এবং সেখানকার বিপদগুলোর সম্পর্কে ধারণা দিতে এবং সর্বোপরি এর মাধ্যমে তারা একে অপরকে সতর্ক করতো। এরপর যখন মানুষ বলতে শিখলো তখন একই চিত্রই সে কিছু পারিপার্শ্বিক উপাদানের বর্ণনার মাধ্যমে নাটকীয়ভাবে বলতে লাগলো। অর্থাৎ, একজন মানুষ যদি শিকারের জন্য বাইরে গিয়ে সফলভাবে ফিরে আসতো, তাহলে সেখানে সে যেসব বিপদগুলোর মুখোমুখি হতো, সেগুলোকে সে কতটা সাহসিকতা, বীরত্বের সাথে মোকাবিলা করেছে, তার বর্ণনা দিতো অনেক রহস্যময় করে। তার এই অভিজ্ঞতার গল্পে তিনি ছিলেন ‘নায়ক’।
১৪৫০ সালে গুটেনবার্গের মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের পর সমাজে গড়ে ওঠে পাঠক শ্রেণী। ১৬শ ও ১৭শ শতাব্দীর মধ্যে প্রথম রূপকথাগুলোকে লিপিবদ্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। গল্পগুলোর বিষয়বস্তু ছিল সমস্যা, সমস্যার সমাধান, অপরাধ এবং অপরাধের শাস্তি, ন্যায়-অন্যায়ের ধরণ, ভালো-মন্দের মধ্যে পার্থক্য, প্রেম-ভালোবাসা, স্নেহ—প্রভৃতি। এই বিষয়বস্তুগুলোকেই বর্ণনা করা হতো জাদুকরী, অলৌকিক, কাল্পনিক বিভিন্ন চরিত্রের মাধ্যমে যেখানে সবচেয়ে সাহসী, বীর, ভালো হিসেবে উপস্থাপন করা ব্যক্তি ছিলেন ‘নায়ক’। সেই নায়ক-ই পাঠকশ্রেণীর কাছে ‘আইডল’ হয়ে উঠতে থাকে। এবং পাঠক, শ্রোতাদের মধ্যে তার মতো হয়ে উঠার আকাঙ্ক্ষা মনের মধ্যে বীজ বুনতে থাকে।
১৬ শতকের শেষ দিকে এসে স্বতন্ত্র ব্যক্তি ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে বই ক্রয় করে সংগ্রহে রাখার ধারা শুরু হয়। এগুলো পাঠকের কাছে সরবরাহ করতে ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকে প্রকাশক এবং স্পন্সর ধারণা। ১৯ শতকের শুরুর দিকে বইয়ের পাশাপাশি অনেক সাময়িকী, ম্যাগাজিন এবং সংবাদপত্র নিয়মিত প্রকাশ পেতে শুরু করলো। মুদ্রণযন্ত্র মুদ্রণশিল্পকে সস্তা করার জন্য বাজারে এর সংখ্যাও বাড়তে থাকে। ক্রমেই নির্দিষ্ট বিষয়ের জন্য নির্দিষ্ট পাঠক গড়ে ওঠে। অর্থাৎ কোনো নির্দিষ্ট সামাজিক গোষ্ঠী বা নির্দিষ্ট একটা স্থানে সংগঠিত হওয়ার পরিবর্তে মানুষ কোনো ধরনের শারীরিক উপস্থিতি ছাড়াই একজন নির্দিষ্ট লেখক, বা নির্দিষ্ট বিষয়ের অনুসরণ করার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে থাকে।
প্রযুক্তি ও সমাজের ধারাবাহিক পরিবর্তন, বিশেষ করে শহরের মানুষ বৃদ্ধি, সড়কপথের যোগাযোগের উন্নয়ন এবং শিক্ষিতের হার বৃদ্ধি এবং একইসাথে অন্যান্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের কারণে বই ও সাময়িকী প্রকাশের ছোট বাজার একটি বৃহৎ ইন্ডাস্ট্রি হয়ে ওঠে। এই মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রিগুলো তাদের পরিকল্পনা এবং স্বার্থের সুবিধা অনুযায়ী অডিয়েন্সের নির্দিষ্ট গঠন ও আকার দিয়ে থাকে। অন্যদিকে মিডিয়ার সরবরাহ করা বিনোদন ও তথ্যের বিনিময়ে জনসাধারণ অর্থ প্রদান করতে শুরু করে এবং গড়ে ওঠে একটা নতুন ভোক্তা বিশ্ব।
১৯ শতকের এই সময়েই চলচ্চিত্র আবিষ্কারের শুরুর দিকে এটাকে একটি ব্যবসা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে আমেরিকার বিভিন্ন শহরে থিয়েটার গড়ে ওঠে। প্রযোজকদের উদ্দেশ্য ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে থিয়েটারে আনা। এ কারণে তারা চলচ্চিত্রের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র নির্দিষ্ট অভিনেতা ও অভিনেত্রীকে প্রদান করে এবং তাদেরকে আইডল হিসেবে প্রচার করতে থাকে। উত্থান ঘটে ‘স্টার’ প্রক্রিয়ার। আর এটা চলচ্চিত্রকে অসাধারণ জনপ্রিয় করে তোলে।
১৯ শতকে সংবাদপত্র এবং ম্যাগাজিনের উত্থান এবং একইসাথে ভোক্তা সংস্কৃতির গড়ে ওঠার মাধ্যমে এই সময়েই পণ্যের বিজ্ঞাপনের প্রসার ঘটে। ১৯৩০-এর দশকে আমেরিকায় জনপ্রিয় ব্যক্তিদের অর্থাৎ বিভিন্ন সেক্টরের স্টারদের জনপ্রিয়তা আর ইমেজকে ব্যবহার করে পণ্যের প্রচারমূলক বিজ্ঞাপন শুরু হয়। এর বিনিময়ে সেই ব্যক্তিকে অর্থ প্রদান করা শুরু হয়, প্রসার ঘটে সেলিব্রিটি সংস্কৃতির। সময়ের পরিক্রমায় সেলিব্রিটিরা ব্র্যান্ডের সমর্থক হয়ে ওঠে।
’৯০-এর দশকের ভক্তের ধরণটা সম্পর্কে বলা যায়, সেই সময় একজন ভক্ত তার পছন্দের মানুষকে একজন ‘মহানায়কের’ চরিত্রে দেখতে চাইতো। মিডিয়ায় তার সম্পর্কে প্রকাশিত, প্রচারিত বিভিন্ন সংবাদ, সাক্ষাৎকার, বিজ্ঞাপন থেকে প্রাপ্ত বার্তা নিয়ে তার সম্পর্কে ভক্তের মননে এক ধরনের অবয়ব তৈরি হতো। এই অবয়বের বৈশিষ্ট্যগুলো এমন ছিল যে, স্বতন্ত্র ব্যক্তি সমস্ত বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারে, সমস্ত প্রতিকূল পরিবেশকে তিনি তার অনুকূলে আনতে পারেন। আবার মিডিয়ায় চিত্রিত তার শান্ত, ধীর-স্থির চরিত্রের মধ্যেই নিহিত থাকে ভয়কে জয় করার মানসিকতা, হারকে জয়ে রূপান্তরিত করার মানসিকতা। জীবনে এগিয়ে যাওয়ার পথে সফলতা প্রাপ্তির জন্য এই বৈশিষ্ট্যগুলোরই প্রয়োজন। সাধারণ মানুষ, অর্থাৎ ভক্তরা স্বতন্ত্র ব্যক্তিকে অনুসরণ করতেন, তার মতো হতে চাওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। অর্থাৎ স্বতন্ত্র সেই ব্যক্তি ভক্তের কাছে এক ধরনের ‘রোল মডেল’ হয়ে উঠতেন।
একবিংশ শতাব্দীতে এসে এই ‘রোল মডেল’ হয়ে যায় ‘ইনফ্লুয়েন্সার’। ২০০৪ সালের দিকে সামাজিক মিডিয়া হিসেবে ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামের আবির্ভাবে এক দশকের ব্যবধানে ক্রমেই একটা নতুন ধরনের ভক্তশ্রেণীর উদ্ভব হয়।
অর্থাৎ ‘তামিমিয়ান’, ‘সাকিবিয়ান’,
‘মাশরাফিয়ান’-ও তৈরি হয়ে গেছে বিপিএলের জন্য
ক্রিকেটকে প্রিমিয়ার লিগ হিসেবে ভক্তনির্ভর ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) জন্ম হয় ২০০৮ সালে, আর বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) শুরুর সময় ২০১২ সাল। ফ্র্যাঞ্চাইজি মডেলনির্ভর বিপিএলে অর্থের বড় একটা অংশ আসে সেই এই ভক্তদের কাছ থেকে। মাঠে, মাঠের বাইরে হাজারো আয়োজন করা হয় এই টুর্নামেন্টকে ভক্তদের কাছে জনপ্রিয় করার জন্য।
ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগেও ‘এমএসডিয়ান’, ‘রোহিতিয়ান’, ‘বিরাটিয়ান’ ভক্ত আছে। ফেসবুকে, ইউটিউবে স্বতন্ত্র এই খেলোয়াড়দের নিয়ে তাদের মধ্যে বাকবিতন্ডাও দেখা যায়। লিগ খেলার ধরণটাই এরকম এবং তাদের মূল লক্ষ্যই ভক্তদের ধরে রাখা। এখন ফেসবুকে ফ্যানবেস্ড পেজ, ফ্র্যাঞ্চাইজি বেস্ড ফ্যানপেজও আছে, ভক্তদের জন্য আয়োজন করা হয় বিভিন্ন ধরনের জার্সি-পেপার প্রভৃতি।
আসলে মিডিয়ার পরিবেশের পরিবর্তন এবং সেই পরিবর্তিত পরিবেশে নতুন নতুন মিডিয়া পণ্যের চাহিদা মোতাবেক সমাজে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ভক্তশ্রেণী গড়ে তোলা হয়েছে। আর তামিমের ‘তামিমিয়ান’, ‘সাকিবিয়ান’, ‘মাশরাফিয়ান’-ও ভক্তকেন্দ্রিক ক্রিকেট কার্নিভাল বিপিএলের সৃষ্টিই।
তাহলে তামিমের ‘তামিমিয়ান’, ‘সাকিবিয়ান’, ‘মাশরাফিয়ান’ কে, বা কারা?
গেল বছর জুলাই অভ্যুত্থানের পর অক্টোবর মাসে দেশে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে সাকিব তার শেষ টেস্ট ম্যাচ খেলার ইচ্ছেপোষণ করেন। এই ইচ্ছেকে সম্মান প্রদর্শন করে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড বাংলাদেশে টেস্ট স্কোয়াডে তার নাম ঘোষণা করলে বিপত্তি দেখা দেয়। এক দল তরুণ, যারা সাকিবের বিরুদ্ধে মিরপুর স্টেডিয়ামের সামনে বিক্ষোভ করতে থাকে। সাকিবের নাম না সরালে তারা তার ‘মিরপুর ব্লকেড’ করবে বলে জানান। পরবর্তীতে বিক্ষোভকারী প্রতিনিধিরা বিসিবির কাছে স্বারকলিপি প্রদান করেন। এরপরে স্কোয়াড থেকে সাকিবের নাম সরানোর পর ‘সাকিবিয়ান’ ব্যানারে সাকিবের সমর্থকরা বিক্ষোভ করেন। তারাও বিসিবির কাছে স্বারকলিপি প্রদান করেন। এরপর বিভিন্ন নাটকীয়তার পর সাকিব দেশে না ফিরতে পারলে দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া, পাল্টা ধাওয়া, সংঘর্ষ হয়। বলতে দ্বিধা নেই, বিপিএলের মঞ্চে তামিমের বলা ‘তামিমিয়ান’, ‘সাকিবিয়ান’, ‘মাশরাফিয়ান’- এরাই। অর্থাৎ বৃহৎ অর্থে, তামিমের ‘তামিমিয়ান’, ‘সাকিবিয়ান’, ‘মাশরাফিয়ান’ ধারণা রাজনীতির সাথেও জড়িয়ে পড়েছে।
এই ঘটনার পূর্বেও টুর্নামেন্ট চলাকালীন ফেসবুক পেজে আমরা বিভিন্ন সময়ে এই ভক্তদের একে অপরের বিরুদ্ধে কথা বলতে দেখেছি। কিন্তু এই ঘটনার স্রষ্টা আসলে কে? এই ভক্তির দায় আসলে কার? ভক্তদের?
ক্রিকেট জীবনের অবসর নেওয়ার পূর্বেই ২০১৮ সালে রাজনীতিতে যোগদান করেন তৎকালীন বাংলাদেশের জাতীয় দলের ওয়ানডের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। সেই সময়ের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের হয়ে জাতীয় নির্বাচনে লড়াইয়ের জন্য তিনি মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন। পরের বছর নড়াইল-২ আসন থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। এর চার বছর পর ২০২৩ সালে তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে সাকিব আল হাসানও আওয়ামী লীগের হয়ে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন এবং পরের বছর তার এলাকা মাগুরা-১ আসন থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে তারা রাজনীতি করবেন কি না—এটা অবশ্যই তাদের মৌলিক অধিকার বিষয়। কিন্তু এটা তাদের খেলোয়াড়ী জীবনের শেষ হওয়ার পূর্বেই কেন?
আবার বিপিএলের আয়েরও অন্যতম উৎসই ভক্তশ্রেণী। সামাজিক মিডিয়ার কল্যাণে এই ভক্তশ্রেণী বিভিন্ন ফেসবুকে বিভিন্ন পেজ খুলে বিভিন্ন খেলোয়াড়কে সমর্থন করতে দেখা যায়। তারাই তাদের পেজের নাম রাখে তামিমের ভক্ত ‘তামিমিয়ান’, সাকিবের ভক্তরা ‘সাকিবিয়ান’, এভাবেই মাশরাফির ভক্তরা ‘মাশরাফিয়ান’ নামে পেজ খোলে। এবং তাদের পছন্দের খেলোয়াড়দের বিভিন্ন ইভেন্টস, তথ্য, ভিডিও প্রভৃতি শেয়ার করেন। পরে দেখা যায়, তারা একে অপরের বিরুদ্ধে কথা বলছে। সামাজিক মিডিয়ার যুগে ট্রলিং খুব সাধারণ একটা বিষয় হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা দেখেছি এই বিষয়গুলো তামিম এবং সাকিবের মধ্যকার সম্পর্কে বিরোধিতা সৃষ্টি করেছে। প্রশ্ন হলো, ভক্তদের এসব বিরোধিতা আন্তর্জাতিক একজন খেলোয়াড় হয়ে তারা কেন প্রবেশ করলেন?
তাহলে মোটের উপর প্রশ্ন—বাংলাদেশ বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে যখন যোগ্যতা-সম্পন্ন বেশ কিছু খেলোয়াড়কে একসঙ্গে পেল, তখন কেন দলে দু’জন তারকা খেলোয়াড়ের মধ্যে ‘বন্ধুত্ব’ থেকে ‘শত্রুতা’র সম্পর্কের দিকে এগুলো এবং স্থায়ী হয়ে উঠলো? কেন এটাকে স্থায়ী করা হলো? দলের জুনিয়রদের কাছে তারা অন্যদের ‘অনুপ্রেরণা’ না হয়ে কেন ‘ভয়ের কারণ’ হলেন? কেন আনন্দ দেওয়ার, পছন্দের দুই তারকার জন্য পৃথক পৃথক বলিষ্ঠ ভক্তশ্রেণী গড়ে উঠলো? ‘বলিষ্ঠ’ একারণেই লিখলাম, কারণ তারা পরস্পরকে ‘দেখতে’ বা ‘সহ্য করতে না পারার’ পর্যায়ে চলে গিয়েছিলেন। এখন দিন শেষে, তামিম তার বিদায়বেলায় এর পুরো দায় ভক্তশ্রেণীকেই দিয়ে গেলেন! ভক্তদের মধ্যকার এই বিভক্তির জন্য তামিম-সাকিব কি কোনোভাবে দায়ী নন? ভক্তদের কাছে কেন তারা কেবল ‘আইডল’ হয়ে থাকতে পারলেন না?
একজন তামিমকে দেখে আরও ১০ জন তামিম তৈরি হয়। একজন সাকিবের জন্যই আরও ১০ জন সাকিব তৈরি হয়। যারা খেলাটাকে পেশা হিসেবে নিতে চান, তারা তাদের অগ্রজকে অনুসরণ করেই স্বপ্ন দেখেন তাঁর মতো হয়ে ওঠার। কিন্তু তামিম, সাকিব কি এধরনের কোনো মনোগত প্রভাব তৈরি করতে পেরেছেন? তাঁরা রেখে গেছেন রেষারেষির সংস্কৃতি, ভক্তদের বিরোধিতার সাথে তাল মিলিয়ে ভক্তদের মধ্যে তৈরি করেছেন বিভক্তি।
এই ভুলগুলোর যেন আর পুনরাবৃত্তি না হয়, এজন্য দায়িত্ব নিতে হবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে (বিসিবি)। বিসিবির আচরণবিধির মধ্যে অবশ্যই এটা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে যেন কোনো খেলোয়াড় তাঁর অবসরের পূর্বেই কোনো ধরনের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হতে না পারেন।
দ্বিতীয়ত, দায়িত্ব নিতে হবে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে (বিকেএসপি)। বিকেএসপিতে ২০১৬ সালে ‘ক্রীড়াবিজ্ঞান’ নামে একটি বিভাগ খোলা হয়। অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের জন্য ক্রীড়াবিজ্ঞান বিভাগের অধীনে ১০ মাসের একটি ডিপ্লোমা কোর্সেরও উদ্বোধন করা হয়। এর মধ্যে “ক্রীড়া মনোবিজ্ঞান” (Sports Psychology) নামে একটি বিষয় আছে। এর পাঠ্যসূচি হালনাগাদ করে সামাজিক মিডিয়ার আবির্ভাবে খেলাধুলার পরিমণ্ডলে যে পরিবর্তনগুলো হচ্ছে সেগুলো শনাক্ত করতে হবে। সেই বিষয়গুলো খেলোয়াড়দের মধ্যে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে—তাও অনুসন্ধান করতে হবে।
প্রতিটি ঘরোয়া এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেট টুর্নামেন্টে কোনো খেলোয়াড় বা খেলা-সংশ্লিষ্ট কেউ কোনো ধরনের ট্রলিং বা সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন কি না—এদিকে নজর দিতে হবে, এবং তা নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে তা বিকেএসপির ক্রীড়াবিজ্ঞান বিভাগে পেশ করতে হবে। এর মাধ্যমে তারা কিছু নির্দেশনা তৈরি করতে পারবেন।
একজন তামিম, সাকিব যেন শত শত তামিম, সাকিব তৈরি করতে পারেন, তাঁরা যেন ভক্তদের মধ্যে অনুসরণীয় হয়ে উঠতে পারেন—সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। সামাজিক মিডিয়ার কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ যেন কোনোভাবে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের কারণ না হয়ে ওঠে—এটা নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি, একটি সুস্থ, স্বাভাবিক, অনুপ্রেরণামূলক ড্রেসিং রুম সংস্কৃতি নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক পরিচিত:
বর্তমানে কর্মরত আছেন জাতীয় দৈনিক দ্য ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস-এ জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক হিসেবে। স্নাতকোত্তর ও স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে। তার আগ্রহের জায়গা হলো জেনারেশন-মিডিয়া রিলেশনশিপ, মিডিয়া-স্পোর্টস আন্তঃসম্পর্ক, সামাজিক মিডিয়া এবং সংবাদ কনসেপ্ট নিয়ে। লেখকের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ইমেইল করুন এই ঠিকানায়: jannatulruhi@gmail.com
Disclaimer: The views expressed in this article are the author's own and do not necessarily reflect The Insighta's editorial stance. However, any errors in the stated facts or figures may be corrected if supported by verifiable evidence.