সংস্কারে গণভোট আলাপ যেভাবে এলো
ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে ২২টি মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব ঘিরে তৈরি হয় ‘গণভোট’ বিতর্ক। প্রথমে ইসলামী আন্দোলন প্রস্তাব দেয়, পরে জামায়াত ও বিএনপি সমর্থন করে, যা নিয়ে রাজনীতিতে তৈরি হয়েছে নতুন উত্তেজনা।
The idea of a referendum emerged amid deadlock in the Consensus Commission’s reform talks. Initially proposed by Islami Andolon and later endorsed by Jamaat and BNP, it reflected frustration over failed consensus. Though the government resisted, the referendum debate exposed deep political rifts and shifting power strategies within the reform process.
দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংস্কার আলোচনায় বিভিন্ন ইস্যুতে মতানৈক্য থেকেই গণভোটের ধারণা উঠে আসে। ইসলামী আন্দোলনের প্রস্তাবকে পরে জামায়াত ও বিএনপি সমর্থন দিলে কমিশন ‘আদেশ–গণভোট–সংসদ’ ক্রমে সংস্কার বাস্তবায়নের পথে যায়। চরমোনাই পীরের দলের এ প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত পুরো সংস্কার প্রক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। কয়েক মাস ধরে চলা সংস্কার সংলাপ নিয়মিত কাভার করার অভিজ্ঞতা থেকে নিজের এমন পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন দৈনিক সমকাল পত্রিকার রিপোর্টার রাজিব আহমদ। গত ১ নভেম্বর নিজের ফেইসবুক পেইজে দেয়া এক পোস্টে তিনি এ পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করেন। দ্যা ইনসাইটা’র পাঠকদের জন্য রাজিব আহমদের লেখাটি এখানে তুলে ধরা হলো :
নিয়মিত কাভার করার সুবাদে ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ, জুলাই সনদ এবং বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মনোভাব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। এ অভিজ্ঞতা থেকে গণভোটের আলাপ কীভাবে এলো, তা বলতে পারি।
ছয়টি সংস্কার কমিশনের ১৬৬টি সুপারিশ নিয়ে গত মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত দলগুলোর সঙ্গে পৃথক বৈঠক করে ঐকমত্য কমিশন। সেই সময়ে ৬২টি বিষয়ে ঐকমত্য হয়। ৮৪টি প্রস্তাব দলগুলো নাকচ করে।
বাকি ২০টি সুপারিশকে মৌলিক সংস্কার হিসেবে চিহ্নিত করে ৩ জুন থেকে সবদলকে নিয়ে সংলাপ শুরু করে কমিশন। এর মধ্যে ছিল জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের প্রস্তাব। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, তৃতীয় বৃহত্তম দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত এমন শক্তিশালী একটি কাউন্সিল যা তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেবে। এটি একটি সুপার গভর্নমেন্ট আইডিয়া ছিল। এটা বাদের বদলে বিএনপি প্রধানমন্ত্রী পদের মেয়াদ ১০ বছর করার প্রস্তাব দেয়। কয়েকদিনের বিতর্কের পর, এনসিসি বাদ যায় সংলাপ থেকে।
তখন সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগে পৃথক পৃথক সাংবিধানিক কমিটি করার প্রস্তাব আসে। এভাবে মৌলিক সংস্কার ২০ থেকে ২১ এ পরিণত হয়। পরে যোগ হয় পুলিশ কমিশনের প্রস্তাব। জুন এবং জুলাই মাসের সংলাপে পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন পদ্ধতিসহ কয়েকটি সংস্কার প্রস্তাবে বিএনপি নোট অব ডিসেন্ট দেওয়ায় চরমোনাইয়ের পীরের দল ইসলামী আন্দোলন প্রথমবারের মত গণভোটের প্রস্তাব করে। (সংযুক্তি : জামায়াত প্রথম দফা সংলাপে গণভোটের কথা বলছিল)। তারা বলে, ঐকমত্য যেহেতু হচ্ছে না, তাই ২২টি মৌলিক সংস্কারে গণভোট হোক। ওখানেই সমাধান হবে। ভিপি নূরের দল গণঅধিকার পরিষদ প্রথম এটাকে সমর্থন করে। পরে জামায়াত সমর্থন করে।
কিন্তু গণভোট কখনও সংলাপের এজেন্ডাভুক্ত করা হয়নি। কারণ সরকার ও কমিশন গণভোটের ঝামেলায় যেতে রাজি ছিল না। কিন্তু জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দল রোজ গণভোটের কথা বলত। এভাবে জুলাই শেষ হয়। শেষ সময়ে ঝড়ো গতিতে সংলাপ শেষ হয়, শেষ দিনে পাঁচটি সংস্কার প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্টসহ ঐকমত্য ঘোষণা করা হয়। অথচ আগের ২২ দিনে ১৭টি বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
আগস্টে চলে জুলাই সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে সংলাপ। তখনও আলোচ্যসূচিতে কমিশন গণভোট অন্তর্ভূক্ত করেনি। কিন্তু জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দল এ দাবি জানিয়েই যাচ্ছিল। এর মধ্যে প্রথমবারের মতো কমিশনের বিশেষজ্ঞ প্যানেল ২৪ আগস্ট গণভোটকে বাস্তবায়নের একটি পরামর্শ হিসেবে উপস্থাপন করে। তবে তা সংলাপে তোলা হয়নি। কমিশন তখনও গণভোটে রাজি ছিল না। ৮ সেপ্টেম্বর সমকালে রিপোর্ট প্রকাশ হয়, ‘সাংবিধানিক আদেশে সনদ বাস্তবায়ন, বাদ যেতে পারে গণভোটের চিন্তা’
বিএনপির শুরুতে অবস্থান ছিল সনদ বাস্তবায়ন করবে আগামী সংসদ। সনদ হবে একটি রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল বা জেন্টেলম্যান এগ্রিমেন্ট। যেই ক্ষমতায় যাক, সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার আগেই করবে। ১৪ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টার উপস্থিতিতে প্রস্তাব করে সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি কী হবে, এ বিষয়ে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আপিল বিভাগের মতামত নেওয়া যেতে পারে। তিন দিন পর নাটকীয়ভাবে জানায়, বিএনপিও গণভোটে রাজি। তবে তা হবে নির্বাচনের পরে। কারণ, আগে গণভোট করলেও পরে আরেকটি করতে হবে। এরপর গণভোট সংলাপের আলোচ্যসূচিতে আসে। তখন সংবাদপত্রে প্রতিবেদন হয়েছিল, বিএনপি প্রতিনিধিরা দলের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই গণভোটের বিষয়ে রাজি হয়েছেন। পরে এ নিয়ে নাকি দলের মধ্যে বিরুপ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল।
বিএনপি রাজি হওয়ার পর কমিশন, বিশেষজ্ঞ প্যানেল গণভোটকে সমাধান ধরে এগোতে শুরু করে। সিদ্ধান্ত হয়, আদেশ-গণভোট-সংসদ এই ক্রনোলজিতে সংস্কার হবে। তখন জামায়াত, এনসিপি, গণঅধিকার, এবি পার্টিসহ অন্যান্য দল বেঁকে বসে। তাদের ভাষ্য, যদি গণভোটই হয়, তবে কীসের নোট অব ডিসেন্ট! কারণ, জুলাইয়ে বলা হয়েছিল যেহেতু ঐকমত্য হচ্ছে না, গণভোটে ফয়সালা হোক। গণভোট যেহেতু হচ্ছে, তাই নোট অব ডিসেন্টের মূল্য নেই।
৫ অক্টোবর বিএনপি প্রথমবারের মত জানায়, আগে পরে নয় গণভোট হতে হবে নির্বাচনের দিনেই। এর পরের ঘটনাবলী আশা করি আপনাদের সবার জানা। মূল কথা হচ্ছে, গণভোটের দাবিটা তুলেছিল চরমোনাই পীরের দল। পরে জামায়াত বারবার এন্ডোর্স করার পরও আলোচ্যসূচিতে আনতে পারেনি। বিএনপি রাজি হওয়ার পর, কমিশন বারবার এড়িয়ে যাওয়া এই পদ্ধতি সামনে আনে। পরে এনসিপিও গণভোটের দাবিতে সোচ্চার হয়। আবার আগে গণভোটের পক্ষে থাকা গণঅধিকার পিছটান দেয়। একমাত্র বামগুলো শুরুতে গণভোটের বিপক্ষে ছিল, শেষ দিনেও ছিল।
About the Author
Rajib Ahamod is a Bangladeshi journalist. He has been working for the daily Samakal since 2009. His areas of work include politics, political analysis, human rights, labor protection, and infrastructure development.
Disclaimer: The views expressed in this article are the author’s own and do not necessarily reflect The Insighta’s editorial stance. However, any errors in the stated facts or figures may be corrected if supported by verifiable evidence.



