সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রে আপসহীন বেগম খালেদা জিয়ার প্রস্থান
নয় বছরের এরশাদবিরোধী আন্দোলন থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত বাংলাদেশের বহু মোড়ে ছিল খালেদা জিয়ার ছাপ। তাঁর আপসহীনতা ও দৃঢ়চেতা স্বভাব তাঁকে সর্বজনগ্রাহ্য জাতীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে
Begum Khaleda Zia, widely regarded as a symbol of patriotism and resistance to hegemony, died in Dhaka on December 30 at the age of 80 while undergoing treatment. The Insighta family mourns her passing. A two-term elected prime minister and BNP chairperson, she is remembered for steadfast leadership on sovereignty, democracy, and the struggle against authoritarianism.
স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্রের প্রশ্নে আপসহীন অবস্থানের প্রতীক, এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও দেশীয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের দৃঢ় স্তম্ভ, বেগম খালেদা জিয়া পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তিনি ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ৮০ বছর। ইনসাইটা পরিবার তাঁর এই মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত।
বেগম জিয়া ১৯৯১-১৯৯৬ এবং ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং ১৯৮৪ সাল থেকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের চেয়ারপারসন ছিলেন। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে তিনি ছিলেন এক ব্যতিক্রমী মুসলিম নারী নেত্রী, তার আপোষহীন অবস্থান, দৃঢ়চেতা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, দেশপ্রেম তাকে অন্যন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে। ফলে তিনি জাতীয় ব্যক্তিত্ব হিসাবে সবার কাছে গ্রহণীয় ছিলেন। ১৯৪৬ সালের ১৫ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে জন্ম নেওয়া এই নারী সাধারণ গৃহবধূর জীবন থেকে ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছিলেন নিজের দৃঢ়তা, ধৈর্য ও নেতৃত্বগুণে।
খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে আগমন কোনো পূর্বপরিকল্পিত উচ্চাকাঙ্ক্ষার ফল ছিল না। অকুতোভয় সেনানী ও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী হিসেবে তিনি দেখেছেন রাষ্ট্র ও রাজনীতির কঠিন বাস্তবতা। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার ঘোষণা, সিপাহী–জনতার বিপ্লব, সব কিছুর নীরব সাক্ষী ছিলেন তিনি। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর ইতিহাস তাঁকে সামনে ঠেলে দেয়। তিনি উত্তরাধিকার নয়, যোগ্যতার শক্তিতে নেতৃত্ব নেন।
স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। নয় বছরের আপসহীন সংগ্রামের পর ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৯১-এর নির্বাচন এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তন, সবকিছুতেই তাঁর দৃঢ়তা ও প্রজ্ঞার ছাপ। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী, কিন্তু তাঁর অর্জন কেবল লিঙ্গভিত্তিক সীমানায় সীমাবদ্ধ নয়; তিনি ছিলেন সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আপসহীন রাষ্ট্রনায়ক।
আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে আপোষহীন
খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট ও সাহসী অবস্থান। দিল্লির সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন, ফারাক্কা ইস্যু আন্তর্জাতিক মঞ্চে তোলা, ‘লুক ইস্ট’ নীতিতে চীন ও মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার, সবকিছুই ছিল একটি স্বাধীন ও আত্মমর্যাদাশীল পররাষ্ট্রনীতির প্রতিফলন। ১৯৯২ সালে নয়াদিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সামনে অবৈধ অভিবাসন প্রসঙ্গে তাঁর দৃঢ় জবাব আজও ইতিহাসে অনন্য দৃষ্টান্ত। ১৯৯৭ সালের এক ভাষণে মানিক মিয়া এভিনিউতে তিনি বলেন ‘বাংলাদেশে ভারতের আধিপত্য বিস্তারের কোনো চক্রান্তই বাস্তবায়ন হতে দেবো না।’ এছাড়া ইন্ডিয়া টুডে পুনম পান্ডের লেখা ‘ইন্ডিয়া–বাংলাদেশ ডমেস্টিক পলিটিক্স’ বইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে জানায়, বেগম জিয়া ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিমা রাওয়ের ‘বহু বাংলাদেশি অবৈধভাবে ভারতে বসবাস’ করার অভিযোগে বলেন ‘“ভারতে বাঙালিরাও বাংলা বোঝেন, বাংলায় কথা বলেন—এর মানে এই নয় যে তারা সবাই বাংলাদেশি।”
এই আপসহীনতাই তাঁকে বারবার ষড়যন্ত্র, প্রতিহিংসা ও নির্যাতনের মুখে ঠেলে দিয়েছে। ‘ওয়ার অন টেরর’-এর অপবাদ, এক–এগারোর অগণতান্ত্রিক অধ্যায়, ২০০৮–পরবর্তী ফ্যাসিবাদী শাসন, সব মিলিয়ে তাঁকে দীর্ঘ নয় বছরের বেশি সময় বন্দিত্ব ও চিকিৎসাবঞ্চনার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। এটি কোনো ন্যায়বিচার ছিল না; ছিল পরিকল্পিত রাজনৈতিক নিপীড়ন। ক্যান্টনমেন্টের বাসভবন থেকে উচ্ছেদ, কারাগারে অমানবিক অবহেলা, সবকিছু তিনি সহ্য করেছেন মাথা উঁচু করে।
দেশপ্রেমের অনন্য দৃষ্টান্ত
শেষ জীবনেও তিনি আপসহীন ছিলেন। গুরুতর অসুস্থ শরীর নিয়েও তিনি ভাঙেননি। মুক্তি পেয়ে বিদেশে চিকিৎসা নিয়ে যখন তিনি ধীরে ধীরে সুস্থতার পথে, তখন জাতি আশাবাদী হয়েছিল, ফ্যাসিবাদ–উত্তর বাংলাদেশে তিনি হয়তো জাতীয় ঐক্যের বাতিঘর হবেন। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে প্রতিশোধ নয়, ভালোবাসা ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ার আহ্বান ছিল তাঁর রাজনৈতিক পরিণতির শ্রেষ্ঠ প্রকাশ।
খালেদা জিয়া ছিলেন ধৈর্যের প্রতীক। স্বামী হারানোর শোক, সন্তানের মৃত্যু, দীর্ঘ রোগযন্ত্রণা, সবকিছুর মধ্যেও তিনি মানুষের ওপর আস্থা রেখেছেন। “এই দেশের মাটি–মানুষই আমার সবকিছু” এই বিশ্বাসেই তিনি জীবনের কঠিনতম সময় পার করেছেন। তাঁর শ্রবণক্ষমতা, পরমতসহিষ্ণুতা ও প্রয়োজনে সমঝোতার মানসিকতা তাঁকে কেবল আন্দোলনের নেত্রী নয়, রাষ্ট্রনায়ক হিসেবেও উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে।
আজ তিনি নেই, কিন্তু তাঁর উত্তরাধিকার রয়ে গেছে, স্বাধীনতার প্রশ্নে আপসহীনতা, আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ়তা, গণতন্ত্রের জন্য ত্যাগ। তিনি ছিলেন জাতির অভিভাবক, ঐক্যের প্রতীক, ভারতীয় আধিপত্যবাদবিরোধী রাজনীতির এক মুখ। তাঁর প্রস্থান আমাদের জন্য শোকের, কিন্তু তাঁর জীবন আমাদের জন্য দায়িত্বের।
বিশ্ব নেতৃবৃন্দের শোক
বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে শোক, সমবেদনা ও তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ, যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ জাতিসংঘ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বনেতারা। শোক, শ্রদ্ধা, প্রার্থনা, স্মৃতিচারণ করছেন দেশ-বিদেশের অসংখ্য মানুষ।
তার মৃত্যুকে ঘিরে বিশিষ্টজনের মন্তব্য
অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল গণমাধ্যমে বলেছেন, বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুর পেছনে শেখ হাসিনার দায় রয়েছে। তিনি বলেন, ওনাকে জেলখানায় বিভিন্ন সময় যেভাবে নির্যাতন করা হয়েছিল, ওনাকে আমরা হয়তো এত তাড়াতাড়ি হারাতাম না। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, বেগম জিয়ার এই মৃত্যুর পেছনে ফ্যাসিস্ট যে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা এবং ওনার যে সরকার ছিল, অবশ্যই তার দায় রয়েছে।
২০২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম শীর্ষ ছাত্রনেতা হাসনাত আবদুল্লাহ তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেইজে দেয়া এক পোস্টে লিখেছেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে বেগম খালেদা জিয়া সবকিছু হারিয়েছেন।
গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা হাসনাত কাইয়ূম স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, বেগম খালেদা জিয়া তার জীবনের কঠিন সময়েও নিজের কথা না ভেবে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য উদ্বিগ্ন ছিলেন এবং রাজনীতিবিদদের প্রতি দেশ বাঁচানোর আকুতি জানিয়েছিলেন।
সাংবাদিক ও লেখক রাজিব আহম্মদ এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, রাজনীতিকদের মধ্যে একমাত্র বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি পক্ষপাত ছিল আমার। সাংবাদিক হিসেবে তা থাকার কথা ছিল না, তবু তা ছিল মুগ্ধতার কারণে। দৃঢ় ব্যক্তিত্ব, বাংলাদেশ ও জনগণের স্বার্থ রক্ষায় আপোসহীনতার কারণে কোটি কোটি মানুষের মত আমিও খালেদা জিয়ার গুণমুগ্ধ ছিলাম, আছি।
বাংলাদেশের ৫৪ বছরের ইতিহাসে হাতেগোনা কয়েকজন জাতীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন, যারা ছিলেন সর্বজনগ্রাহ্য। বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি থাকবেন অমর হয়ে বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে। বিদায় হে মহিয়সী!!!
Disclaimer: The views expressed in this article are the author’s own and do not necessarily reflect The Insighta’s editorial stance. However, any errors in the stated facts or figures may be corrected if supported by verifiable evidence.




