শেখ হাসিনার পতন ও নতুন বাংলাদেশের অভ্যুদয় (১ম পর্ব)
ক্ষমতার চূড়া থেকে অনেকটা আকস্মিকভাবে শেখ হাসিনার পতনের কারণ কি? ২০২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে নতুন আশাবাদের সঞ্চার হয়েছে, তা বাংলাদেশকে কোন্ দিকে নিয়ে যাবে?
Sheikh Hasina’s fall from power and her death sentence by International Crimes Tribunal have reshaped national politics in Bangladesh. As the July 2024 uprising fuels new hopes, questions loom, what led to her dramatic downfall, and what direction will Bangladesh take as a historic political dynasty faces reckoning?
২০২৪- এর জুলাই অভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুূদণ্ডে দন্ডিত হওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম। এর আগে বিভিন্ন সময়ে বিশ্বের অন্তত ৪৭ জন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। তাদের মধ্যে এ যাবৎ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে ৩৫ জনের। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অনেক রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের বিরুদ্ধে ছিল স্বৈরাচারী শাসন, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ। মৃত্যুদণ্ড পাওয়া রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের মধ্যে আছেন রোমানিয়ার প্রেসিডেন্ট নিকোলাই চসেস্কু, কুখ্যাত ফ্যাসিস্ট নেতা ইতালির প্রধানমন্ত্রী বেনিতো মুসোলিনি, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট সেলাল বায়ার, পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো, ইরানের প্রধানমন্ত্রী আমির-আব্বাস হোভেইদা, ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস, কঙ্গোর স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা এবং স্বাধীন কঙ্গোর প্রথম প্রধানমন্ত্রী প্যাট্রিস লুমুম্বা, কঙ্গোর প্রেসিডেন্ট জোসেফ কাবিলা।
প্রাচীন আমল থেকে আধুনিক যুগে এমন আরো অনেক সম্রাট, রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান বিভিন্ন অপরাধে কিংবা কখনো রাজনৈতিক বিবাদে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। এর মধ্যে মৃত্যুদণ্ড পেয়েছেন সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম চার্লস। তার আগের শতকে একই সাজা পেয়েছিলেন রানী লেডি জেন। স্কট রানী মেরির প্রাণ যায় শোড়শ শতাব্দীতে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে গিলোটিনে প্রাণ যায় ফ্রান্সের রাজা লুই ষোড়শের।
এখন বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার ফলে উপমহাদেশ তথা সমসাময়িক পৃথিবীর অন্যতম আলোচিত-সমালোচিত রাজনৈতিক পরিবারের পতন সূচিত হলো কিনা, তার সঠিক উত্তর সময়ই বলে দিবে। এই লেখায় শেখ হাসিনার রাজনীতিতে আগমন, আন্দোলন-সংগ্রামে তার অংশগ্রহন এবং ক্ষমতার মসনদে উত্থান ও পতনের প্রকৃত কারণগুলো নির্মোহ দৃষ্টিতে অনুসন্ধানের চেষ্টা করা হয়েছে। পুরো বিষয়টি আলোচনা করা হয়েছে তিন পর্বে। আজকের এই পর্বে থাকছে বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা।
বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা
শেখ হাসিনার ক্ষমতায় আরোহনের পটভূমি
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫ সন্তানের মধ্যে শেখ হাসিনা সবার বড়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল সেনা কর্মকর্তার সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন বঙ্গবন্ধু। নিহত হন তাঁর স্ত্রী বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, তিন ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশু শেখ রাসেল। নিহত হন বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের ও ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনিসহ তাঁর ঘনিষ্ঠ আরো কয়েকজন আত্মীয়-স্বজন ও সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা। তবে স্বামীর সঙ্গে জার্মানিতে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান শেখ হাসিনা এবং বঙ্গবন্ধুর আরেক কন্যা শেখ রেহানা।
এর পরের ইতিহাসও সুবিদিত। ৭ বছরের প্রবাসজীবন থেকে দেশে ফিরে ১৯৮১ সালের ১৭ মে পিতার রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হাল ধরেন শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রক্ষমতায় তখন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নায়ক ও বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। শেখ হাসিনা দেশে ফেরার মাত্র ১৩ দিনের মাথায় চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে একদল বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন জিয়াউর রহমান।
জাতীয় বেইমান ইস্যু ও শেখ হাসিনা
জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট হন তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তার। তবে কয়েক মাস পরেই ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বন্দুকের নল দেখিয়ে ক্ষমতা দখল করেন সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সামরিক আইন জারি করে স্বৈরতান্ত্রিক কায়দায় দেশ শাসন করতে থাকেন তিনি।
কিছুকাল পর জেনারেল এরশাদ জাতীয় পার্টি নামে নিজস্ব রাজনৈতিক দল গঠন করে সামরিক আইন প্রত্যাহার করেন এবং সবার জন্য রাজনীতি উন্মুক্ত করে দেন। এরইমধ্যে এরশাদবিরোধী আন্দোলন শুরু করে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো। বিএনপির নেতৃত্বে তখন জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। অর্থাৎ, দেশের প্রধান দুই দলের নেতৃত্বে দু’জন স্বজনহারা নারী।
দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেয়ার কথা বলে ১৯৮৬ সালে সংসদ নির্বাচনের (৩য় সংসদ নির্বাচন) ঘোষণা দেন জেনারেল এরশাদ। তবে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা ঘোষণা করেন, স্বৈরাচার এরশাদের অধীনে কেউ নির্বাচনে যাবে না। শেখ হাসিনা আরো বলেন, যে নির্বাচনে যাবে সে জাতীয় বেইমান হবে। অথচ এ কথা বলার পরও তিনি নির্বাচনে যান এবং তার দল আওয়ামী লীগ ৭৬টি আসন পেয়ে সংসদে প্রধান বিরোধী দল হয়। ১৯৮৬ সালের ৭মে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে ব্যাপক ভোট ডাকাতি ও কারচুপি করে ১৫৩টি আসন পায় এরশাদের জাতীয় পার্টি। জামায়াতে ইসলামী পায় ১০টি আসন। অন্যদিকে নির্বাচনে অংশ না নিয়ে রাজপথে আন্দোলন অব্যাহত রাখে বিএনপি। এতে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে আপোষহীন নেত্রীর তকমা পান বেগম খালেদা জিয়া।
এরশাদের পতন ও শেখ হাসিনার স্বপ্নভঙ্গ
নির্বাচন দিয়ে দেশে বেসামরিক শাসন ও গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন এইচএম এরশাদ। তবে সেটা যে ছিল স্রেফ ভাঁওতাবাজি তা প্রকাশ পেতে বেশিদিন লাগেনি। এরশাদ পার্লামেন্টের কোন তোয়াক্কাই করতেন না। নিজের খেয়ালখুশি মতোই দেশ চালাতেন তিনি। নিজের মর্জিমাফিক আইন করে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংসদে পাস করিয়ে নিতেন। ফলে ‘রাবার স্ট্যাম্প পার্লামেন্ট’ তকমা পায় এই সংসদ। এরশাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগও উঠতে শুরু করে জোরেসোরে।
এমন পটভূমিতে রাজপথে এরশাদবিরোধী আন্দোলন জোরদার হয়। সরকারের দমন-পীড়ন, জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতনের মাত্রাও বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে সংসদ থেকে জামায়াতে ইসলামীর এমপিরা পদত্যাগ করলে ১৯৮৭ সালের ৬ ডিসেম্বর সংসদ ভেঙে দেন স্বৈরাচার এরশাদ।
এরপর ক্ষমতার মসনদে নিজের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় একতরফা নির্বাচনের আয়োজন করেন এরশাদ। ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রধান রাজনৈতিক দলই এই নির্বাচন বর্জন করে; যেমন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ, ন্যাপ (মুজাফ্ফর) এবং বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। নির্বাচনে জাতীয় পার্টি জয় লাভ করে, তারা ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৫১টি আসন লাভ করে। নির্বাচনে ভোট প্রদানের হার ছিল ৫২.৫ শতাংশ।
অতঃপর অনেক আন্দোলন, সংগ্রাম, আর বহু ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগের বিনিময়ে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ছাত্র-শিক্ষক-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে পতন হয় স্বৈরাচার এরশাদের। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, ও বামপন্থী দলগুলোর নেতৃত্বাধীন তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী দেশের প্রধান সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহনে অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহাসিক ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ এই নির্বাচনে শেখ হাসিনার স্বপ্নভঙ্গ করে বিজয়ী হয় বেগম খালেদা জিয়ার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। তবে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ১৫১টি আসন না পাওয়ায় সংকটে পড়ে দলটি। এমন পরিস্থিতিতে ১৪০ আসন পাওয়া বিএনপিকে সরকার গঠনে সমর্থন দেয় ১৮টি আসন পাওয়া দল জামায়াতে ইসলামী। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নারী প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া। এভাবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নারী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় বড় ভূমিকা রাখে ইসলামপন্থী দল জামায়াতে ইসলামী।
গণতন্ত্রে উত্তরনের সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয়া ঐতিহাসিক এই নির্বাচনে ৮৮টি আসন পেয়ে প্রধান বিরোধীদল হয় শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ। আর কারান্তরীণ পতিত স্বৈরাচার এরশাদ একাই ৫টি আসনসহ মোট ৩৫ আসন নিয়ে তৃতীয় স্থান পায় তার দল জাতীয় পার্টি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে এই নির্বাচন বিপুল সমাদৃত হলেও শেখ হাসিনা বলেন, নির্বাচনে সুক্ষ্ম কারচুপি হয়েছে।
শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়া দ্বৈরথ
দীর্ঘ ৯ বছরের স্বৈরশাসন অবসানের পর নতুন আশা ও স্বপ্ন নিয়ে পথচলা শুরু করে বাংলাদেশ। শুরুর কয়েকটি মাস সেই আশা ও স্বপ্নের পালে হাওয়াও লেগেছিল দারুণ, যখন ক্ষমতাসীন বিএনপি ও বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধভাবে দেশে প্রেসিডেন্ট শাসিত সরকারব্যবস্থা থেকে প্রধানমন্ত্রী শাসিত সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে এই সুন্দর সময় বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।
শুরুতেই বাঁধে গোলমাল। দলের শীর্ষ নেতা অধ্যাপক গোলাম আজমকে প্রকাশ্যে আমীর ঘোষণা করে জামায়াতে ইসলামী। যদিও মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকার জন্য তার নাগরিকত্ব বাতিল করেছিল বঙ্গবন্ধু সরকার। সেই নাগরিকত্ব তখনও বাতিলই ছিল। একজন অনাগরিককে জামায়াতের আমীর ঘোষণা করায় তোলপাড় শুরু হয় দেশের রাজনীতিতে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত হয় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। গোলাম আজমকে গ্রেফতার ও বিচারের দাবি তোলেন তারা। এতে সমর্থন দেয় আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী দলগুলো। উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাজপথ। এমন পরিস্থিতিতে অনেকটা কোনঠাসা হয়ে পড়া জামায়াতের পাশ থেকে সরে যায় বিএনপিও। এ সময় দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলও চড়াও হয় জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের ওপর। হামলায় নিহত হন শিবিরের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী। অথচ জামায়াতের সমর্থনেই সরকার গঠন করতে পেরেছিল বিএনপি।
গোলাম আজমকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়লে তাকে গ্রেফতার করে সরকার। এরইমধ্যে, ১৯৯৪ সালের ২০ মার্চ অনুষ্ঠিত মাগুরা-২ আসনের উপনির্বাচনে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক ভোট কারচুপি ও জালিয়াতির অভিযোগ করে আওয়ামী লীগ। তবে তা নাকচ করে দেয় বিএনপি। এই ঘটনার পর বিএনপি সরকারের অধীনে আর কোন নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দেয় আওয়ামী লীগ। শুরু হয় ২ নেত্রীর তিক্ত ক্ষমতার লড়াই।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন শুরু করেন শেখ হাসিনা। সঙ্গে পেয়ে যান পতিত স্বৈরাচার এরশাদের জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতকেও। তখন কিন্তু শেখ হাসিনার কাছে একাত্তরের মানবতাবিরোধী বা যুদ্ধাপরাধী ছিলেন না জামায়াত নেতারা!
শেখ হাসিনার উত্থান
১৯৯৪ সালের মাঝামাঝি আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টি-জামায়াত একটি নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা দিয়ে তা সংবিধানে সন্নিবেশ করার দাবিতে সরকারকে আল্টিমেটাম দেয়। তবে এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেন, পাগল ও শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ হতে পারে না।
সরকারকে বেধে দেয়া সময়ের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে না নেয়ায় ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে সংসদ থেকে একযোগে পদত্যাগ করেন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের ১৪৭ জন এমপি। এরপর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকারবিরোধী আন্দোলনে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাজপথ। টানা হরতাল ও অবরোধে একপ্রকার অচল হয়ে পড়ে দেশ। জনজীবন হয় বিপর্যস্ত। দু’পক্ষই অনড় থাকে নিজ নিজ অবস্থানে। প্রবল আন্দোলন ও সহিংসতার মুখে ১৯৯৫ সালের ২৪ নভেম্বর সংসদ ভেঙে দেয় সরকার। এরপর ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী ভোট গ্রহণের দিন ধার্য করে ৬ষ্ঠ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। তবে তফসিল প্রত্যাখ্যান করে রাজপথের আন্দোলন আরো জোরদার করে আওয়ামী লীগ-জাপা-জামায়াত।
অনড় থাকেন খালেদা জিয়াও। সব বাধা, বিঘ্ন, আন্দোলন, সহিংসতা উপেক্ষা করে একতরফা নির্বাচন করেন তিনি। প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় ৪৮ আসনে ভোটের আগেই নির্বাচিত হন বিএনপির প্রার্থীরা। শেষমেষ নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৯টিতে জয় পায় বিএনপি। ১টি আসন পেয়ে বিরোধীদলীয় নেতা হন বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত হত্যাকারী কর্ণেল (অব.) ফারুক রহমান। বাকি ১০টি আসনে জয়ী হন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এই নির্বাচনে ভোট প্রদানের হার ১০ শতাংশেরও কম হতে পারে বলে নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়।
বিতর্কিত এ নির্বাচনের পর রাজপথের আন্দোলন আরো তীব্র হয়ে ওঠে। প্রবল আন্দোলনের মুখে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংযুক্ত করে নির্বাচনের মাত্র দেড় মাসের মাথায় সংসদ ভেঙে দিতে বাধ্য হন খালেদা জিয়া। সংবিধানে সদ্য সন্নিবেশিত বিধান অনুযায়ী বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত হয় নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
ক্ষমতার মসনদে শেখ হাসিনা
১৯৯৬ সালের ১২ জুন ভোট গ্রহনের দিন ধার্য করে ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। অতীতের ভুল-ত্রুটির জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে নির্বাচনী প্রচারে নামেন শেখ হাসিনা। একটিবারের জন্য তাকে ক্ষমতায় বসানোর আহ্বান জানান ভোটারদের প্রতি। অবশেষে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘ ২১ বছর পর নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের সুযোগ পায় আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পায় ১৪৬টি আসন। আর বিএনপি পায় ১১৬টি এবং জাতীয় পার্টি ৩২টি আসন। ৩টি আসন নিয়ে চতুর্থ স্থানে থাকে জামায়াতে ইসলামী।
তবে এককভাবে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ১৫১টি আসন না পাওয়ায় স্বৈরাচার এরশাদের জাতীয় পার্টি ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ-রব)’কে সাথে নিয়ে ‘ঐকমত্যের সরকার’ গঠন করেন শেখ হাসিনা। এরশাদকে কারাগার থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসেন সংসদে আর জাতীয় পার্টির মহাসচিব আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে যোগাযোগমন্ত্রী এবং জাসদ নেতা আসম আব্দুর রবকে করেন নৌপরিবহন মন্ত্রী।
অর্থাৎ, ভোট ও ভাতের অধিকারের কথা বলে ও আন্দোলন-সংগ্রাম করে গণতন্ত্রের মানসকন্যা উপাধি পাওয়া শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আরোহনের ঊষালগ্নেই শহীদ নূর হোসেন ও ডাক্তার শামসুল আলম খান মিলনসহ স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সব শহীদ ও গণতন্ত্রকামী জনতার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেন।
ক্ষমতায় আরোহনের পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা মনোনিবেশ করেন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারে। বাতিল করেন বিচারের পথ রুদ্ধ করে রাখা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। ক্ষমতার মসনদ সংহত করার লক্ষ্যে রাষ্ট্র ও প্রশাসনের প্রায় সর্বত্র শুরু করেন ব্যাপক দলীয়করণ, পারিবারিকীকরন ও আত্মীয়করণ। এ সময় গঙ্গার পানি বন্টনে ভারতের সাথে ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তি করেন শেখ হাসিনা। এরপর পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাথে শান্তি চুক্তি করে সরকার। চুক্তির আওতায় পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। বিপরীতে অস্ত্র সংবরন করে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতি।
এদিকে সংসদের ভেতরে ও বাইরে বঙ্গবন্ধু ও জিয়াউর রহমানকে নিয়ে শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া এবং সেই সাথে আওয়ামী লীগ-বিএনপি নেতাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। সংসদে বিরোধী দলগুলোর দাবি দাওয়াগুলো উপেক্ষিত হয়। সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াসহ বিএনপির এমপিরা একনাগাড়ে দীর্ঘ দিন অনুপস্থিত থাকায় সংসদের কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
একপর্যায়ে ১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দুঃশাসনের অভিযোগ তুলে একযোগে আন্দোলন, নির্বাচন ও সরকার গঠনের লক্ষ্য সামনে রেখে ৪ দলীয় জোট গঠন করে বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামি ও ইসলামি ঐক্যজোট। অবশ্য কিছুদিন পর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তার দলকে নিয়ে জোট থেকে বেরিয়ে গেলেও নাজিউর রহমান মঞ্জু’র নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির একটি অংশ জোটে থেকে যায়। দেশে শুরু হয় জোটের রাজনীতি।
নির্বাচনে শেখ হাসিনার পরাজয়, আবারও প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া
নানান ঘটন-অঘটন আর আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে সরকারের ৫ বছরের মেয়াদ শেষে ২০০১ সালের জুলাইয়ে সংবিধান অনুযায়ী সদ্য বিদায়ী প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন শেখ হাসিনা। এর আগেই তিনি তার অনুগত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিয়ে এমনভাবে প্রশাসন সাজিয়ে যান যেন নির্বাচনকালীন প্রশাসন তার পক্ষেই কাজ করে।
তবে শেখ হাসিনার এ পরিকল্পনা ভেস্তে যায় যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেই প্রশাসনের শীর্ষ পদগুলোতে রদবদল করে। সরকারের এ পদক্ষেপকে ‘সিভিলিয়ান ক্যু’ আখ্যা দিয়ে এর কঠোর সমালোচনা করেন শেখ হাসিনা। একইসাথে বিচারপতি লতিফুর রহমানের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তোলেন তিনি। তবে তার এসব অভিযোগ রাজনৈতিক অঙ্গনে তেমন একটা প্রভাব ফেলেনি।
২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল বিজয় অর্জন করে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন চারদলীয় ঐক্যজোট। এই জোটের শরিক দলগুলো সব মিলিয়ে ২১৬টি আসনে জয়ী হয়, যার মধ্যে এককভাবে বিএনপি জেতে ১৯৩টি আসনে। আর ৬২টি আসন নিয়ে সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসে আওয়ামী লীগ। দেশে-বিদেশে সর্বত্র এই নির্বাচনের ভুয়সী প্রশংসা করা হলেও শেখ হাসিনা বলেন, স্থুল কারচুপি করে আওয়ামী লীগকে হারিয়ে দেয়া হয়েছে।
নির্বাচনের ফল ঘোষণার পরপরই দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাংচুরের ঘটনা ঘটে, যা চারদলীয় জোটের সরকার গঠনের পরও কিছুদিন অব্যাহত থাকে।
বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নবগঠিত সরকারের প্রধান চমক ছিল জামায়াতের আমীর মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ। এর মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামী স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সরকারের অংশীদার হয়ে ওঠে।
এই ঘটনার পর বিএনপি ও জামায়াতকে নিশানা করে কঠোর সমালোচনা শুরু করেন শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতারা। এছাড়া নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণে সাধারণ যে চিত্র উঠে আসে তাতে দেখা যায়, বেশিরভাগ আসনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে এবং অনেকগুলো আসনে জামায়াত সমর্থকদের ভোটগুলোই বিএনপি প্রার্থীর জয়ে নিয়ামক ভূমিকা রেখেছে। এ বিষয়টিও যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে নেয় আওয়ামী লীগ। যার প্রমান পাওয়া যায় দলটির পরবর্তী রাজনৈতিক কৌশলে।
জামায়াত নেতাদেরকে এবার সরাসরি একাত্তরের মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধী সাব্যস্ত করে ব্যাপক প্রচারণা শুরু করেন শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতারা। একইসাথে ‘যুদ্ধাপরাধীদের’ মন্ত্রী করা এবং তাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দেয়া হয়েছে এমন অভিযোগ তুলে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও বিএনপির কঠোর সমালোচনা করতে থাকেন আওয়ামী লীগ নেতারা।
বাংলার আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা
একটি নতুন শতাব্দী ও নতুন সহস্রাব্দীর সূচনালগ্নে বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট বিপুল বিজয় নিয়ে ক্ষমতায় আসলেও একের পর এক নেতিবাচক ঘটনায় কালো মেঘ জমে বাংলার দিগন্তরেখায়। সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে, যখন সেখানে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। আল্লাহর অশেষ রহমতে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও সংসদের তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা। বেঁচে যান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারাও। সমাবেশের জন্য ট্রাকে স্থাপিত অস্থায়ী মঞ্চে মানববর্ম তৈরি করে শেখ হাসিনাকে ঘিরে ধরেন ঢাকার সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফসহ আওয়ামী লীগ নেতারা। ট্রাকের পাশ দিয়ে তখন একের পর এক বিস্ফোরিত হচ্ছে ভয়ংকর আর্জেস গ্রেনেড। বিস্ফোরণে মর্মান্তিকভাবে নিহত হন মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী। আহত হন আরো ৩শ জন। কানে আঘাত পান শেখ হাসিনা। নৃশংস এ হামলার জন্য বিএনপি সরকারকে দায়ী করে আওয়ামী লীগ। তবে এমন অভিযোগ নাকচ করে হামলার জন্য উল্টো আওয়ামী লীগকেই দায়ী করে বিএনপি।
ভয়াবহ এই হামলার ঘটনা নতুন এক ঘৃণা ও ক্ষতের জন্ম দেয় বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে চারদলীয় জোট সরকারের বিতর্কিত ভূমিকায় বিএনপি-জামায়াতের সাথে আওয়ামী লীগের তিক্ততা প্রবলতর হয়ে ওঠে।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ছাড়াও খালেদা জিয়ার এই শাসনামলে আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা, গাজীপুরে সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা, দেশের উত্তরাঞ্চলে বাংলা ভাই নামে এক চরমপন্থীর উত্থান, বাংলা ভাই ও আব্দুর রহমানের নেতৃত্বাধীন জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ-জেএমবি কর্তৃক দেশের ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা হামলা, চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক, সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে অপারেশন ক্লিনহার্ট, টানা ৪ বার দুর্নীতিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন, প্রধানমন্ত্রীপুত্র তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ– একের পর এক এসব ঘটনায় অশান্ত হয়ে ওঠে দেশের পরিবেশ।
এসবের মধ্যেই ফুরিয়ে আসতে থাকে চারদলীয় জোট সরকারের মেয়াদ। এ সময় প্রধান বিচারপতি কেএম হাসানকে পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে পেতে সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীতে বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের বয়সসীমা বাড়ানো হয়েছে বলে অভিযোগ তোলে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে কারচুপি করার অভিপ্রায়ে এই সংশোধনী আনা হয়েছে দাবি করে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দেন শেখ হাসিনা। এরইমধ্যে ডান ও বামপন্থী কয়েকটি দল নিয়ে ১৪ দলীয় মহাজোট গঠন করে আওয়ামী লীগ। পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হিসেবে বিচারপতি কেএম হাসানকে প্রত্যাখ্যান করে দলের নেতাকর্মীদের লগি-বইঠা নিয়ে রাজপথে আন্দোলনে নামার প্রস্তুতি নিতে বলেন শেখ হাসিনা। এমন পরিস্থিতিতে দেশজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে। দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘাতে জড়ায় সরকার সমর্থক ও বিরোধীরা। এমনই এক অশান্ত পরিবেশে একটি সংবাদে চমকিত হয় বাংলাদেশ, যখন ২০০৬ সালের ১৩ অক্টোবর নোবেল শান্তি পুরষ্কারে ভূষিত হন ক্ষুদ্র ঋণের প্রবক্তা ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস।
লগি-বৈঠার তাণ্ডব, নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের যুগে বাংলাদেশ
চারদলীয় জোট সরকারের মেয়াদের শেষ দিন ছিল ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর। ওইদিনই সদ্য বিদায়ী প্রধান বিচারপতি কেএম হাসানের নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তাকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মানতে একেবারেই রাজি ছিল না আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট। এই ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে সংলাপের পাশাপাশি দেশজুড়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল বিরোধী জোট। সমঝোতার প্রচেষ্টায় বিএনপি-আওয়ামী লীগ সংলাপ ব্যর্থ হলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। লগি-বইঠা নিয়ে রাজপথে নেমে পড়েন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ২৭ অক্টোবর রাতে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করে বিবৃতি দেন বিচারপতি কেএম হাসান। এ ঘটনায় রাজপথে আওয়ামী লীগের অবস্থান আরো সংহত হয়।
পরদিন ২৮ অক্টোবর রাজধানীর পল্টনে রক্তক্ষয়ী সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন আওয়ামী লীগ ও জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা। সংঘাতের একপর্যায়ে জামায়াত-শিবিরের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
ওদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণে বিচারপতি কেএম হাসান অপারগতা প্রকাশ করায় সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমেদ ২৯ অক্টোবর অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদের প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণের সমালোচনা করলেও তার অধীনে ৯ম সংসদ নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেন শেখ হাসিনা। একইসাথে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও ত্রুটিমুক্ত ভোটার তালিকা তৈরির দাবি জানান তিনি। তবে তার এ দাবি গ্রহণ না করে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি ভোট গ্রহণের দিন ধার্য করে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন।
এরইমধ্যে এরশাদের জাতীয় পার্টিকে নিয়ে নির্বাচনী মহাঐক্যজোট গঠন করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট। কিন্তু এরশাদসহ জোটের কয়েকজন প্রার্থীকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হলে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন শেখ হাসিনা। তার এমন ঘোষণার পরও নির্বাচন আয়োজনে অনড় থাকে সরকার।
রাজনীতিতে চরম নাটকীয়তা ও এক-এগারোর সরকার
আওয়ামী লীগ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণার পাশাপাশি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিনের সরকারের বিরুদ্ধে হরতাল-অবরোধসহ সর্বাত্মক আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করে। এসময় সরকার ও বিরোধীপক্ষের মধ্যে সমঝোতার জন্য প্রকাশ্য তৎপরতা চালান ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাতিসংঘের কূটনীতিকরা। ওদিকে রাজপথের নিয়ন্ত্রণ তখন অনেকটাই আওয়ামী লীগের হাতে। এতসব কিছুর মধ্যেও নির্বাচনের লক্ষ্যে অনড় থাকে সরকার। এমনই এক প্রেক্ষাপটে নির্বাচনের মাত্র ১১ দিন আগে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে দেশে জরুরি অবস্থা জারি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করেন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন। পরদিন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ডক্টর ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত হয় সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। নিজেদের আন্দোলনের ফসল দাবি করে এই সরকারকে স্বাগত জানান শেখ হাসিনা। বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দেন আওয়ামী লীগসহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের নেতারা। তবে অনুপস্থিত ছিলেন বেগম খালেদা জিয়াসহ বিএনপি ও চারদলীয় জোটের শরিক দলগুলোর নেতারা।
সেনাসমর্থিত এই সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান শুরু হয়। গ্রেফতার হন বড় বড় ব্যাবসায়ীরা। একইসাথে আটক করা হয় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের বহু নেতাকে। একপর্যায়ে গ্রেফতার করা হয় সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকেও। আটক করা হয় খালেদা জিয়ার দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানকে। আটক হন জামায়াতের আমীর মতিউর রহমান নিজামী। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে মামলাও করে সরকার। পরবর্তীতে অবশ্য একে একে মুক্তি দেয়া হয় খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাসহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক নেতাকে।
ডক্টর ফখরুদ্দীন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রায় ২ বছরের মাথায় ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দেন। ‘দিন বদলের সনদ’ শিরোনামে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন শেখ হাসিনা।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় অর্জন করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাঐক্যজোট। সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৬৩ আসনে জয়ী হয় এই জোট, যার মধ্যে আওয়ামী লীগ এককভাবে পায় ২৩০ আসন। অন্যদিকে নির্বাচনে ভরাডুবি হয় বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের। এককভাবে মাত্র ৩০টি আসন পায় বিএনপি। আর তাদের প্রধান শরিক জামায়াত জয়ী হয় ২টি আসনে।
প্রবল পরাক্রমে শেখ হাসিনার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন
নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভের পর ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি সরকার গঠন করেন শেখ হাসিনা। সরকার গঠনের পর থেকে দেশে একের পর এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা ঘটতে শুরু করে। যার মধ্যে কয়েকটি ঘটনার কথা নিম্নে উল্লেখ করা হলো...
পিলখানা ট্র্যাজেডি
শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র ৫০ দিনের মাথায় ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারী ঢাকায় তৎকালীন বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিডিআর-এর সদরদপ্তর পিলখানায় ভয়াবহ হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়। দু’দিনব্যাপী এই হত্যাযজ্ঞে নিহত হন বিডিআর-এর ডিজি মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ সেনাবাহিনীর ৫৭ জন চৌকস কর্মকর্তা। বিডিআর সদস্যদের গুলি ও হামলায় ১৭ জন বেসামরিক নাগরিকও নিহত হন ওই দু’দিনে। নৃশংস এ ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে পড়ে বাংলাদেশসহ গোটা দুনিয়া। প্রাথমিকভাবে এ ঘটনার জন্য বিডিআর সদস্যদের অভ্যন্তরীন অসন্তোষকে দায়ী করা হলেও নিহত সেনাকর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যসহ বিভিন্ন সূত্রে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় ৫ আসামির ফাঁসি
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় ১২ আসামির বিরুদ্ধে নিম্ন আদালতের দেয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখেন। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি ওই ১২ জনের মধ্যে ৫ জনের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করা হয়।
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের উদ্যোগ
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে ২০০৯ সালের জুলাইয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন জাতীয় সংসদে পাস হয়। পরের বছর মার্চে মানবতাবিরোধী অপরাধ/যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিচারে ট্রাইব্যুনাল, আইনজীবী প্যানেল ও তদন্ত সংস্থা গঠন করা হয়।
খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ
২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও সংসদের তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে তার ক্যান্টনমেন্টের বাসভবন থেকে উচ্ছেদ করে সরকার। ওই বাড়িটিতে দীর্ঘ ৩৮ বছর কাটিয়েছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্ত্রী। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর বেগম জিয়াকে নামমাত্র মুল্যে ২.৭২ একর জমিসহ বাড়িটি বরাদ্দ দেন তৎকালীন সেনাপ্রধান এইচএম এরশাদ। তবে ওই বরাদ্দ প্রদান বেআইনি মর্মে ২০০৯ সালের এপ্রিলে বেগম জিয়াকে বাড়ি ছেড়ে দেয়ার নোটিশ দেয় ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড। বিষয়টিতে আদালতের শরণাপন্ন হন বেগম জিয়া। কিন্তু আপিল বিভাগে নিষ্পত্তির আগেই তাকে সেখান থেকে উচ্ছেদ করা হয়।
ফেলানী হত্যা
২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে কুড়িগ্রামের অনন্তপুর-দিনহাটা সীমান্তের খিতাবেরকুঠি এলাকায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফ-এর সদস্যরা ফেলানী খাতুন নামের এক বাংলাদেশি কিশোরীকে গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনার জন্য বিএসএফ ১৮১ ব্যাটালিয়নের চৌধুরীহাট ক্যাম্পের সদস্যদের দায়ী করা হয়। ফেলানীর লাশ ৫ ঘন্টা সীমান্তের কাটাতারে ঝুলে ছিল। বাবার সঙ্গে ফেলানী দিল্লিতে গৃহকর্মীর কাজ করতো। নিজের বিয়ের উদ্দেশ্যে সে দেশে ফিরছিল। ফেলানী হত্যার ঘটনায় দেশে-বিদেশে নিন্দা ও সমালোচনার ঝড় ওঠে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল
২০১১ সালের ১০ মে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে রায় ঘোষণা করেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন ৬ সদস্যের আপিল বিভাগ। তবে সংক্ষিপ্ত এই রায়ে, পরবর্তী ২টি জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে বলে অভিমত দেয়া হয়। আপিল বিভাগের এই রায় ঘোষণার মাত্র ৫০ দিনের মাথায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনে আওয়ামী লীগ সরকার। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গণে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারী ঢাকার পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় নির্মমভাবে খুন হন তরুণ সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারওয়ার ও মেহেরুন রুনি। এ ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে পড়ে পুরো দেশ। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘন্টার মধ্যে সাগর-রুনির ঘাতকদের খুঁজে বের করতে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে নির্দেশ দেন। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের এক যুগ পেরিয়ে গেলেও গ্রেফতার হয়নি কোন আসামী। মামলার চার্জশিটও জমা দেয়নি তদন্ত কর্তৃপক্ষ।
বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী নিখোঁজ
২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল ঢাকার বনানী থেকে নিজ ড্রাইভার আনসার আলীসহ নিখোঁজ হন বিএনপি নেতা সাবেক এমপি এম ইলিয়াস আলী। সরকারের লোকেরা ইলিয়াস আলীকে গুম করেছে বলে অভিযোগ করে বিএনপি। এই ঘটনার এক যুগ পেরিয়ে গেলেও ইলিয়াস আলী নিখোঁজ রহস্যের জট খোলেনি আজও।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ
পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে এই প্রকল্পে অর্থায়ন থেকে সরে যায় বিশ্বব্যাংক। তবে পরবর্তীতে বিশ্বব্যাংকের এই অভিযোগ নিয়ে দায়েরকৃত একটি মামলা খারিজ করে দেয় কানাডার একটি আদালত।
বিশ্বজিৎ দাস হত্যাকাণ্ড
২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকায় সরকারবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ছাত্রলীগ কর্মীরা বিশ্বজিৎ দাস নামের এক যুবককে প্রকাশ্য দিবালোকে শত শত মানুষ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সাংবাদিকদের সামনে লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে ও চাপাতির কোপে নৃশংসভাবে হত্যা করে। পেশায় দর্জি ২৫ বছরের যুবক বিশ্বজিৎ কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না।
ঘটনাবহুল ২০১৩ সাল
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের শেষ বছর ছিল ২০১৩ সাল। সংবিধান অনুযায়ী এরপরই নতুন জাতীয় নির্বাচন। সেই হিসেবে ২০১৩ সাল ছিল নির্বাচনী বছর। এমন প্রেক্ষাপটে নানান ঘটন-অঘটনে উত্তাল ছিল এই বছরটি।
গণজাগরণ মঞ্চের উত্থান
২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারী একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় জামায়াতের অন্যতম শীর্ষ নেতা আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তবে এই রায় প্রত্যাখ্যান করে তার ফাঁসির দাবিতে ঢাকার শাহবাগ চত্বরে জড়ো হতে শুরু করেন অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট ও ব্লগাররা। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই শাহবাগ চত্বরে মানুষের ঢল নামতে শুরু করলে ডাক্তার ইমরান এইচ সরকারের নেতৃত্বে গঠিত হয় গণজাগরণ মঞ্চ। শাহবাগের অনুকরণে দেশের প্রায় সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এই আন্দোলন। কাদের মোল্লাসহ যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত সব আসামির মৃত্যুদণ্ড ও জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি জানানো হয় গণজাগরণ মঞ্চ থেকে। অচিরেই আন্দোলনে যোগ দেয় বামপন্থী বিভিন্ন সংগঠন। সংহতি প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতারা। তুমুল আন্দোলনের মাত্র ১২ দিনের মাথায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ১৯৭৩ সংশোধন করে সংসদে আইন পাস হয়। এই আইনের আওতায় ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আপিল বিভাগ। একই বছরের ১২ ডিসেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
দেলাওয়ার হোসেন সাইদি’র মৃত্যুদণ্ড, দেশজুড়ে সহিংসতা
গণজাগরণ মঞ্চের সফল আন্দোলনের কয়েকদিন বাদেই ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারী একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মুফাসসিরে কুরআন, জামায়াতের প্রভাবশালী নেতা, সাবেক এমপি আল্লামা দেলাওয়ার হোসেন সাইদিকে মৃত্যুূদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এ খবর ছড়িয়ে পড়তেই দেশজুড়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সাইদির ভক্ত, সমর্থক, অনুরাগীরা। বিক্ষোভ দমনে কঠোর অবস্থান নেয় সরকার। এতে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে। আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে ৩ মার্চ পর্যন্ত নিহত হন অন্তত ৭০ জন। এ ঘটনাকে গণহত্যা হিসেবে আখ্যায়িত করে জামায়াত ও বিএনপি। পরবর্তীতে আপিলে সাইদি’র মৃত্যুদণ্ড রদ করে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় আপিল বিভাগ।
ত্বকী হত্যা
২০১৩ সালের ৬ মার্চ নারায়ণগঞ্জে নিখোঁজ হন মেধাবী ছাত্র তানভীর মোহাম্মদ ত্বকী। ৮ মার্চ তার লাশ পাওয়া যায় শীতলক্ষ্যা নদীতে। ত্বকী হত্যা মামলার তদন্ত কর্তৃপক্ষের ফাঁস হওয়া প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী ওসমান পরিবারের সদস্য আজমেরি ওসমান এই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত। ত্বকী নিখোঁজ হওয়ার পরদিন প্রকাশিত ‘এ’ লেভেল পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, ত্বকী সারাবিশ্বে পদার্থবিজ্ঞানে সর্বোচ্চ ৩০০ নম্বরের মধ্যে ২৯৭ পেয়েছেন। ত্বকী হত্যার ঘটনায় বিক্ষোভে ফেটে পড়ে পুরো দেশ। নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের ১১ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও মামলার চার্জশিটই দেয়া হয়নি আদালতে।
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ঢাকার অদূরে সাভারে রানা প্লাজা নামের একটি বহুতল ভবন ধসে পড়ে। ভবনের কয়েকটি তলা নিচে দেবে যায়। আর কিছু অংশ পাশের একটি ভবনের ওপরে গিয়ে পড়ে। এ ঘটনায় ১১৭৫ জন শ্রমিক নিহত হন। আহত হন দুই হাজারের বেশি। হতাহতদের বেশিরভাগই ছিলেন পোশাক কারখানার কর্মী। বিশ্বের ইতিহাসে এটি তৃতীয় বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। স্হানীয় আওয়ামী লীগ নেতা সোহেল রানার মালিকানাধীন ভবনটির দেয়ালে ফাটল দেখা দেয়ায় ভবনটি ব্যবহার না করার সতর্কবার্তা দেয়া হলেও তা উপেক্ষা করা হয়। এ ঘটনায় দেশে-বিদেশে সমালোচনার মুখে পড়ে শেখ হাসিনার সরকার।
হেফাজতে ইসলামের উত্থান
ফেব্রুয়ারীজুড়ে যখন গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনে উত্তাল রাজধানী ঢাকা, ঠিক তখনই মার্চ মাসে বিস্ময়করভাবে উত্থান ঘটে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের। নির্দিষ্ট কোন রাজনৈতিক দলকে সমর্থনের কথা না বললেও তাদের সুস্পষ্ট অবস্থান ছিল শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে। শাহবাগে নাস্তিকদের নেতৃত্বে গণজাগরণ মঞ্চ চলছে, এমন অভিযোগ তুলে ইসলাম রক্ষাসহ ১৩ দফা দাবীতে ঢাকা অবরোধের কর্মসূচি ঘোষণা করে হেফাজতে ইসলাম। ২০১৩ সালের ৫ মে সারাদেশ থেকে লাখো হেফাজত কর্মী-সমর্থকের ঢল নামে ঢাকার রাজপথে। তাদের উপস্থিতিতে জনসমুদ্রে পরিনত হয় ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বর। সেখানে আয়োজিত সমাবেশে ১৩ দফা দাবি বাস্তবায়নের ডাক দেন হেফাজত নেতারা। এরইমধ্যে সমাবেশের আশেপাশে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন হেফাজতের কর্মী-সমর্থকরা। তুমুল উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে দাবি আদায়ে শাপলা চত্বরে অবস্থানের ঘোষণা দেন হেফাজতের নেতারা। সেদিনই রাত ১২টার কিছু পর পুলিশ, রেব ও বিজিবির সমন্বয়ে শুরু হয় অভিযান। সাউন্ড গ্রেনেড ও ফাঁকা গুলির শব্দে আতঙ্কে হেফাজত কর্মীরা পালিয়ে যেতে শুরু করে। অল্প সময়ের মধ্যেই ফাঁকা হয়ে যায় শাপলা চত্বর। পুলিশ জানায়, ৫ এবং ৬ মে শাপলা চত্বর ঘিরে অভিযানে মোট ১১ জন নিহত হয়। তবে হেফাজতে ইসলাম তাৎক্ষণিকভাবে তাদের কয়েক’শ কর্মীর মৃত্যুর দাবি করে। পরবর্তীতে মানবাধিকার সংগঠন অধিকার ওই সহিংসতায় ৬১ জন নিহতের একটি তালিকা তৈরি করে। হেফাজতে ইসলামের এই উত্থান-পতনে দেশের সমাজ ও রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি হয়।
পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি, বিএনপির জয়
হেফাজতে ইসলামের ওপর ক্র্যাকডাউনের পরের মাসেই ১৫ জুন অনুষ্ঠিত হয় রাজশাহী, সিলেট, খুলনা ও বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এই চার সিটিতেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের হাজার হাজার ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে বিজয়ী হন বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের প্রার্থীরা। এরপর ৬ জুলাই অনুষ্ঠিত হয় গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন। আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাটি হিসেবে বিবেচিত এই সিটির নির্বাচনে দলটির মনোনীত প্রার্থীকে লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন বিএনপির প্রার্থী। জাতীয় নির্বাচনের মাত্র ৬ মাস আগে অনুষ্ঠিত এই ৫ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল থেকে বেশ পরিষ্কার একটা ধারণা পাওয়া যায় যে, নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলে ৬ মাস পর অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনে কী ফলাফল হতে পারে।
ট্রাইব্যুনালে একের পর এক রায়
২০১৩ সালজুড়ে বিভিন্ন সময়ে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আরো ৭ জনকে দণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এদের মধ্যে ছিলেন জামায়াত ও বিএনপির নেতারা। মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে। আর জামায়াতের সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আজমকে ৯০ বছরের কারাদণ্ড এবং বিএনপি নেতা আবদুল আলীমকে আমৃত্যু কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। এছাড়া বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার দায়ে চৌধুরী মঈন উদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন
যুদ্ধাপরাধ ইস্যুর পাশাপাশি বছরজুড়েই রাজপথে উত্তাপ ছড়ায় বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের আন্দোলন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বেশ কয়েক দফা হরতাল, অবরোধ কর্মসূচি পালন করে বিরোধী জোট। তবে নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে বছরের শেষ প্রান্তে এসে। মূলতঃ ২৫ অক্টোবরের পর, সংবিধান অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদ শেষ ৯০ দিনে পৌঁছানোর পর থেকে। ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ-উৎকন্ঠার মধ্যেই চলতে থাকে বিএনপি জোটের হরতাল। তবে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচনের বিষয়ে অনড় থাকে সরকার। দু’পক্ষের অনড় অবস্থানের মধ্যেই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ভোট গ্রহণের দিন ধার্য করে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন।
স্বৈরতন্ত্রের পথে শেখ হাসিনা, ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন
বাংলাদেশের ইতিহাসে একতরফা নির্বাচনের যেসব নজির রয়েছে তার মধ্যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অন্যতম। মূলতঃ এই নির্বাচনের মধ্য দিয়েই দেশে শেখ হাসিনার অবৈধ, অসাংবিধানিক ও ফ্যাসিবাদী শাসনের ভিত পাকাপোক্ত হয়, যা অব্যাহত থাকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট তার পতনের আগ পর্যন্ত।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ওই নির্বাচন বয়কট করায় অর্ধেকের বেশি আসনে ভোট গ্রহণেরই প্রয়োজন হয়নি। সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন আর ৫ জানুয়ারি ভোট গ্রহণ করা হয় বাকি ১৪৭টি আসনে।
অথচ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ৬৫(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ হইতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত তিন শত সদস্য লইয়া এবং এই অনুচ্ছেদের কার্যকরতাকালে উক্ত দফায় বর্ণিত সদস্যদিগকে লইয়া সংসদ গঠিত হইবে, সদস্যগণ সংসদ-সদস্য বলিয়া অভিহিত হইবেন।”
সংবিধানের এই অনুচ্ছেদের শর্ত অনুযায়ী এটা সুস্পষ্ট যে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ৩০০ জন সদস্য লইয়া সংসদ গঠিত হয়নি কারন ১৫৩টি আসনে কোন ভোট গ্রহণই করা হয়নি। আর সংসদ গঠন না হলে সরকার গঠনের কোন সুযোগই থাকে না। ফলে ওই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা যে সংসদ ও সরকার গঠন করেছিলেন তা ছিল সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক, বেআইনি ও অবৈধ।
একইসাথে ৫ জানুয়ারির ওই নির্বাচনে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার। নির্বাচনের এক মাসের কিছু আগে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলে ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর ঢাকায় এসে এরশাদের সঙ্গে দেখা করেন তৎকালীন ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিং। তিনি এরশাদের সঙ্গে বৈঠকে তাকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার অনুরোধ করে বলেন, এ অঞ্চলের স্বার্থেই স্থিতিশীল বাংলাদেশ চায় ভারত। বৈঠকের পরে সুজাতা সিংকে উদ্ধৃত করে এরশাদ বলেন, “জাতীয় পার্টি নির্বাচনে না গেলে জামায়াত-শিবিরসহ উগ্র সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠীর উত্থান হবে, তারা ক্ষমতায় আসবে।”
৫ জানুয়ারির এই নির্বাচন নিয়ে ভারতের পাশাপাশি সক্রিয় তৎপরতা চালিয়েছিল জাতিসংঘ। সংঘাত নিরসন ও সমঝোতার মিশন নিয়ে ঢাকায় আসেন জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। তিনি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতার লক্ষ্যে জোরালো প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু তার সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের তরফেও কিছু তৎপরতা চালানো হয়েছিল। বাংলাদেশের নির্বাচনকে সামনে রেখে দিল্লি সফরে গিয়েছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা।
এ ধরনের নানা নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছিল, ততই সহিংসতাও বাড়তে থাকে। নির্বাচনের আগে দেশের ৩৮টি জেলায় প্রায় দেড়শ’র মতো ভোটকেন্দ্রে অগ্নিসংযোগ করা হয়। বিভিন্ন জায়গায় ব্যালট পেপার ও অন্যান্য নির্বাচনী সরঞ্জাম পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটে।
নির্বাচন প্রতিহত করার ডাক দিয়ে ভোট গ্রহণের আটদিন আগে ২৯ ডিসেম্বর ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপি। সারাদেশ থেকে দলীয় নেতাকর্মীদেরকে ঢাকার নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে আসার আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে সে কর্মসূচি সফল করতে পারেনি বিএনপি। বেগম খালেদা জিয়াকে তার গুলশানের বাসা থেকে বেরই হতে দেয়নি পুলিশ।
লাগাতার অবরোধ, নাশকতা, সহিংসতার মধ্যেই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচন বর্জনের পাশাপাশি প্রতিহত করার ঘোষণা দেয় বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। ভোট গ্রহণের আগের রাতে সারাদেশে প্রায় পাঁচশ’ ভোটকেন্দ্রে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। ভোটের আগের দিন থেকে ভোট গ্রহণ শেষ হওয়া পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতায় অন্তত ১৯ জন নিহত এবং বহু মানুষ আহত হন। এই নির্বাচনে অংশ নেয় আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিসহ মাত্র ১৭টি রাজনৈতিক দল। নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিতি ছিল খুবই কম। এদিন দুপুরে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রধান একটি জোটের নির্বাচন বয়কট এবং রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে ভোটার উপস্থিতি কম।
অথচ দিনশেষে ভোট গণনায় দেখা যায়, বেশিরভাগ আসনে লক্ষাধিক ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা। আর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া ১৪৭টি আসনে ভোটার উপস্থিতি ৪০ শতাংশ বলে জানায় নির্বাচন কমিশন। তবে বিএনপি জোট দাবি করে, ভোট প্রদানের প্রকৃত হার ৪০ শতাংশের চেয়ে অনেক কম। বিতর্কিত এই নির্বাচনে ২৩৪টি আসন পেয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। আর ৩৪টি আসন নিয়ে বিরোধীদলের আসনে বসে জাতীয় পার্টি। পাশাপাশি জাতীয় পার্টির কয়েকজন নেতাকে মন্ত্রী করেন শেখ হাসিনা। আর দলটির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদকে করা হয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। এভাবেই চরম বিতর্কিত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে সহায়তা করার জন্য জাতীয় পার্টিকে পুরষ্কৃত করেন শেখ হাসিনা।
নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনা
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম এবং আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণের তিনদিন পর ৩০ এপ্রিল তাদের মৃতদেহ ভেসে ওঠে শীতলক্ষ্যা নদীতে। এ ঘটনায় স্তম্ভিত হয় বাংলাদেশসহ গোটা দুনিয়া। চাঞ্চল্যকর এ হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার হন নারায়ণগঞ্জে র্যবের সংশ্লিষ্ট ব্যাটালিয়নের প্রধান লে. কর্ণেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদসহ বাহিনীটির ১৭ জন সদস্য এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন। পরবর্তীতে র্যাবের সাবেক কর্মকর্তা ও নূর হোসেনসহ ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয় নারায়ণগঞ্জের একটি আদালত। তবে মামলাটি এখনো উচ্চ আদালতে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে।
জামায়াতের আমীর নিজামীর মৃত্যুদণ্ড
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনাল এবং সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে ২০১৪ সাল জুড়ে বেশ কয়েকটি মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। তবে বিশেষ করে সবার নজর ছিল জামায়াতের আমীর সাবেক মন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামীর মামলার দিকে। সেই মামলায় নিজামীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। একই বছরের ২৩ অক্টোবর ৯০ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের সাবেক আমীর গোলাম আজম বিএসএমএমইউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
আরো একটি ঘটনাবহুল বছর ২০১৫ সাল
৫ জানুয়ারি নির্বাচনের বর্ষপূর্তি ঘিরে রাজনৈতিক সহিংসতা
বাংলাদেশে ২০১৫ সালটিও শুরু হয় প্রচণ্ড রাজনৈতিক উত্তাপ দিয়ে। ৫ জানুয়ারি বিতর্কিত নির্বাচনের এক বছর পূর্তি পালন নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়ে যায় বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। ৫ জানুয়ারি ঢাকায় একটি সমাবেশকে কেন্দ্র করে এর দুদিন আগে থেকে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াকে কার্যত অবরুদ্ধ করে রাখে শেখ হাসিনার সরকার। বেগম জিয়াকে অবরুদ্ধ করে রাখতে তার গুলশান কার্যালয়ের সামনের সড়কে বালুভর্তি ট্রাক ফেলে রাখা হয়। এ ঘটনা দেশে-বিদেশে সমালোচনার জন্ম দেয়।
গুলশানের অফিস থেকে বের হতে না পেরে খালেদা জিয়া দেশজুড়ে লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এতে সারাদেশে নতুন করে উত্তেজনা ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। বেগম জিয়া রাতদিন গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান করতে থাকেন। একপর্যায়ে পুলিশ বিএনপি চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয় থেকে অবরোধ তুলে নিলেও খালেদা জিয়া সেখানেই অবস্থান অব্যাহত রাখেন। টানা ৯২ দিন তিনি সেখানে অবস্থান করেন। অবরোধ চলাকালে পুরো দেশ কার্যত অচল হয়ে পড়ে। এ সময় নাশকতা, পেট্রলবোমা, হামলা, অগ্নিসংযোগ সারাদেশের মানুষের মধ্যে চরম আতঙ্ক সৃষ্টি করে। বার্ন ইউনিটে দুই শতাধিক মানুষের পোড়া শরীর আর তাদের আর্তনাদ দেখে চোখে পানি ধরে রাখতে পারেননি মানুষ। টানা তিন মাসের এই নাশকতা দেশে ও দেশের বাইরে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়।
ভিন্ন মতের মানুষের ওপর হামলা
রাজনৈতিক সহিংসতার পাশাপাশি ২০১৫ সালটি মানুষ আরো যে কারণে মনে রাখবে তা হলো, দেশের বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন মতাবলম্বী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও বিদেশি নাগরিকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা এবং এ ধরনের কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। এ বছর ২৬ ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যায় ঢাকার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের বইমেলা থেকে ফেরার সময় আততায়ীর হামলায় নিহত হন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ব্লগার ও বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক অভিজিৎ রায়। এ ঘটনায় গুরুতর আহত হন তার স্ত্রী রাফিদা বন্যা আহমেদ। অভিজিৎ হত্যার পর মার্চ মাসে খুন হন ওয়াশিকুর রহমান, মে মাসে অনন্ত বিজয় দাস, আগস্টে নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়। এছাড়া অক্টোবরের শেষ দিকে ঢাকায় অন্তত দুটি প্রকাশনা সংস্থায় একযোগে হামলা হয়। প্রকাশনা সংস্থাগুলো থেকে অভিজিৎ রায়ের বেশ কয়েকটি পুস্তক প্রকাশিত হয়েছিল। এদিন জাগৃতি নামের একটি প্রকাশনা সংস্থার মালিক, ফয়সাল আরেফিন দীপন তার কার্যালয়ে নৃশংসভাবে নিহত হন।
বিদেশীরাও হামলার শিকার
২০১৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশানে আততায়ীর হামলায় নিহত হন চেজারে তাভেল্লা নামের এক ইতালীয় নাগরিক। আর ৩ অক্টোবর রংপুরে নিহত হন কুনিও হোশি নামে এক জাপানি নাগরিক। কাছাকাছি সময়ে আরো কয়েকজন বিদেশি নাগরিকের উপর হামলা হলেও তারা বেঁচে যান। এ সময় হামলার আশঙ্কায় অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় ক্রিকেট দল তাদের বাংলাদেশ সফর বাতিল করে।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর হামলা
২০১৫ সালে নজিরবিহীন একটি হামলার ঘটনা ঘটে ঢাকায় শিয়া মতাবলম্বীদের পবিত্র দিন আশুরা উপলক্ষে আয়োজিত তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিকালে। পুরান ঢাকার ইমামবাড়ায় এই হামলাটি হয় ২৩ অক্টোবর গভীর রাতে। হামলায় ঘটনাস্থলেই একজন নিহত হয়, আহত হয় অর্ধশতাধিক।
একইবছর ৪ ডিসেম্বর দিনাজপুরের কাহারোলে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী কান্তজিউ মন্দির প্রাঙ্গণে শতবর্ষ প্রাচীন এক মেলায় বোমা হামলা হয়। আর ১০ ডিসেম্বর ওই কাহারোলেই কৃষ্ণভক্ত হিন্দুদের আরেকটি মন্দিরে একযোগে গুলি ও বোমা হামলা চালানো হয়।
বিদেশি ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের স্থাপনায় হামলাগুলোর দায় তথাকথিত ইসলামিক স্টেট জঙ্গি গোষ্ঠীর নাম দিয়ে স্বীকার করা হয়। যদিও এ বছর বেশিরভাগ ব্লগার হত্যার দায় স্বীকার করে আল কায়েদার কথিত ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা। অনেক বিশ্লেষকই এই দায় স্বীকারের ঘটনাগুলোকে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থানের এক নতুন মাত্রা হিসেবে বর্ণনা করেন। তবে শেখ হাসিনার সরকার বরাবরই বাংলাদেশে আইএস সহ যেকোনো আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীর উপস্থিতির কথা জোরালোভাবে অস্বীকার করে এসেছে।
পৈশাচিক নিষ্ঠুরতা
২০১৫ সালে অন্তত দুটি নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়ে যায়। জুলাই মাসে সিলেটে রাজন নামে এক শিশুকে নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার দৃশ্য ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ক্ষোভে ফেটে পড়ে বাংলাদেশের মানুষ। পরের মাসে খুলনায় রাকিব নামে এক শিশুর মলদ্বার দিয়ে মোটরগাড়ীর চাকায় হাওয়া দেয়ার নল ঢুকিয়ে বাতাস প্রবেশ করিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে, যা মানুষকে ভীষণভাবে বিক্ষুব্ধ করে। নভেম্বর নাগাদ এই দুই শিশু হত্যার বিচার শেষ করে দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তির রায় দেয় আদালত। এত দ্রুত কোন মামলার বিচার করা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা।
কামারুজ্জামান, মুজাহিদ ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি
এ বছর একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির তিনজন প্রভাবশালী নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এপ্রিল মাসে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের। আর নভেম্বরে একযোগে কার্যকর করা হয় জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড।
কয়েকটি ভালো খবর
অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মাঝে ২০১৫ সালে কিছু ইতিবাচক ঘটনারও সাক্ষী হয় বাংলাদেশ। এ বছর ৬ জুলাই জাতিসংঘ ঘোষিত ১৫ বছর মেয়াদের মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল বা এমডিজি শেষ হওয়ার পর দেখা যায়, ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যমাত্রা সফলভাবে পূরন করেছে বাংলাদেশ।
এ বছরই দেশের বহুল আলোচিত পদ্মা বহুমুখী সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়। ১২ ডিসেম্বর পদ্মা নদীর ওপর ছয় কিলোমিটারের বেশি দীর্ঘ এই সেতুর মূল অবকাঠামো নির্মাণের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
২০১৫ সালের অন্যতম আলোচিত ঘটনা ছিল ছিটমহল বিনিময়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতের ১১১টি ও ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল বিনিময় করা হয়। ৩১ জুলাই থেকে এই বিনিময় কার্যকর হয়। বাংলাদেশ-ভারত স্থল সীমান্ত চুক্তির আলোকে ভারতের লোকসভায় দেশটির সংবিধান সংশোধন হয়।
বাংলাদেশকে কাপিয়ে দেয়া হোলি আর্টিজানের জঙ্গি হামলা
২০১৬ সালে বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত ও আতঙ্কের বিষয় ছিল জঙ্গিবাদ। কয়েক বছর ধরে বিচ্ছিন্ন কিছু হামলার পর এ বছরই বাংলাদেশে চালানো হয় দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ জঙ্গি হামলা... ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশানের হোলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে। ২০১৬ সালের পহেলা জুলাই হোলি আর্টিজান বেকারিতে ওই হামলার ঘটনা সারা বিশ্বের নজর ঘুরিয়ে দেয় বাংলাদেশের দিকে। সেই হামলার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল হয়ে পড়ে নিরাপত্তা বাহিনী, সাংবাদিক, সাধারণ মানুষসহ সবাই।
পরদিন সকালে সেনা অভিযানের মধ্য দিয়ে যখন এই ঘটনার পরিসমাপ্তি ঘটে তার আগেই সেখানে নিহত হন ১৭ জন বিদেশিসহ ২২ জন বেসামরিক নাগরিক, দুজন পুলিশ কর্মকর্তা এবং অভিযানে নিহত হয় ৫ জন হামলাকারী।
পহেলা জুলাই হোলি আর্টিজানে নৃশংস জঙ্গি হামলার ঘটনার আগে ২০১৬ সালের প্রথম হামলার ঘটনা ঘটে ফেব্রুয়ারিতে। পঞ্চগড়ে যগেশ্বর রায় নামে একজন হিন্দু পুরোহিতকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। এরপর এপ্রিলে আবার শুরু হয় লেখক-ব্লগার হত্যাকাণ্ড। ৭ এপ্রিল হত্যা করা হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিমুদ্দিন সামাদকে। তার হত্যার দায় স্বীকার করে আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা হিসেবে পরিচিত আনসার আল ইসলাম।
এপ্রিলেই ঘটে পরপর আরো তিনটি হত্যাকাণ্ড। ২৩ এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। এর দুদিন পর ঢাকায় দিনেরবেলা ঘরে ঢুকে হত্যা করা হয় সমকামী বিষয়ক একটি ম্যাগাজিনের সম্পাদক জুলহাস মান্নান এবং তার সঙ্গী মাহবুব তনয়কে। এরপর মে এবং জুন মাসে বান্দরবানে একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুকে হত্যা, নাটোরে একজন খ্রিস্টান ব্যবসায়ীকে হত্যা এবং ঝিনাইদহে একজন হিন্দু পুরোহিতকে গলা কেটে বা কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পুলিশের মতে এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের পেছনে ছিল জঙ্গিবাদের ভিন্ন একটি ধারা, যেটিকে পরে নব্য জেএমবি বলে চিহ্নিত করে পুলিশ এবং এই গোষ্ঠীটি তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের আদর্শে অনুপ্রাণিত বলে মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। পুলিশের মতে, এর কিছুদিন পর গুলশানের হোলি আর্টিজানের হামলাটি চালিয়েছিল এই নব্য জেএমবি গোষ্ঠী। পরবর্তীতে এসব হামলার দায় স্বীকার করে আইএস-এর কথিত সংবাদ সংস্থা আমাক।
হোলি আর্টিজান হামলার পর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বেশ কয়েকটি অভিযান চালায় এবং এসব অভিযানে বেশ কিছু জঙ্গি সদস্য নিহত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অভিযানের ঘটনাটি ছিল জুলাইয়ের ২৫ তারিখে ঢাকার কল্যানপুরে যেখানে ৯ জন জঙ্গি নিহত হয় বলে জানায় পুলিশ। এরপর তিন মাস যাবত অভিযানের মধ্যে নারায়ণগঞ্জে মারা যায় নব্য জেএমবি’র বাংলাদেশ প্রধান বলে চিহ্নিত তামিম চৌধুরী।
তনু হত্যা
জঙ্গিবাদী হামলায় রক্তাক্ত বছর ২০১৬ সালে আরো একটি হত্যার ঘটনায় আলোড়িত হয় বাংলাদেশ। ওই বছরের ২০ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকা থেকে সোহাগী জাহান তনুর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। তনু কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী ছিলেন এবং সেনানিবাসের একটি বাসায় প্রাইভেট পড়াতে যেতেন। সেই বাসার আশপাশে একটি জঙ্গলে তার মরদেহ পাওয়া যায়। তাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করে পুলিশ। তনু হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে তার কলেজের শিক্ষার্থী, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন জোরালো আন্দোলন করে। তবে দীর্ঘ ৮ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও তনু হত্যার বিচার হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি
বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় সাইবার হামলার ঘটনা ঘটে ২০১৬ সালে। সুইফট কোড ব্যবহার করে ৫ থেকে ১০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার সরিয়ে নেয় সাইবার অপরাধীরা। এ ঘটনা কেবল দেশেই নয়, বিশ্বজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করে। এ ঘটনার পর দেশের সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়।
মাওলানা নিজামী ও মীর কাসেম আলীর ফাঁসি
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় জামায়াতের আমীর সাবেক মন্ত্রী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী এবং দলটির আরেক প্রভাবশালী নেতা মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ২০১৬ সালে। মাওলানা নিজামীকে ১১ মে রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসি দেয়া হয়। আর মীর কাসেম আলীকে ফাঁসি দেয়া হয় ৩ সেপ্টেম্বর রাতে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে। এর মাধ্যমে দেশে-বিদেশে চরমভাবে বিতর্কিত আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন-১৯৭৩ এর আওতায়, বিতর্কিত প্রসিকিউশন, বিতর্কিত তদন্ত সংস্থা, বিতর্কিত ট্রাইব্যুনাল ও বিতর্কিত বিচারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে জামায়াতের শীর্ষ ৫ নেতা মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, আবদুল কাদের মোল্লা, মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও মীর কাসেম আলী এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে তা কার্যকর করে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকার।
একইসাথে জামায়াতের সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আজমকে ৯০ বছরের কারাদণ্ড, বিশ্ব নন্দিত মুফাসসিরে কুরআন আল্লামা দেলাওয়ার হোসেন সাইদিকে প্রথমে ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ড এবং পরে সর্বোচ্চ আদালতে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়। পরবর্তীতে এই দু’জনই কারাগারে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরন করেন। এছাড়া সাবেক বিএনপি নেতা আবদুল আলিমকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।
রোহিঙ্গা ঢল, জঙ্গিবিরোধী অভিযান, গুম আতঙ্কের বছর ২০১৭ সাল
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর দ্বারা শুরু হওয়া গণহত্যা থেকে প্রাণ বাচাতে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা শরনার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। প্রথমে শেখ হাসিনার সরকার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশে বাধা দিলেও পরে সীমান্ত এলাকা খুলে দেয়া হয়। এ মুহূর্তে কক্সবাজারে সব মিলিয়ে অন্তত ১২ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। এ বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া এবং তাদের ওপর অত্যাচার নিপীড়ন ও গণহত্যার ঘটনা দেরিতে হলেও বিশ্ব বিবেককে নাড়া দেয়। সীমিত সম্পদ নিয়ে হত্যার শিকার রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানোর পর বাংলাদেশ বিশ্ববাসীর প্রশংসা পায়। পরে এটি বিশ্ব ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। তবে বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে তেমন কোন অগ্রগতি দৃশ্যমান নয়।
জঙ্গিবিরোধী অভিযান
২৪ মার্চ সিলেটের দক্ষিণ সুরমা এলাকায় আতিয়া মহল নামের একটি বাড়িতে স্মরনকালের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী ও দীর্ঘতম সময় ধরে চলা জঙ্গিবিরোধী অভিযান শুরু হয়। বিরাট এই অভিযান সম্পর্কে শুধু টের পান আতিয়া মহলবাসী, সেখানে অবস্থানকারী জঙ্গি, আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। পাঁচদিন ধরে টানা অভিযান, থেমে থেমে গুলি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রেস ব্রিফিং, পাঁচতলা আতিয়া মহলের সব বাসিন্দাদের অভিনব কায়দায় অক্ষত অবস্থায় সরিয়ে নেয়ার শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে দেশবাসী। এ ঘটনার পর মার্চ মাসেই আরো তিনটি স্থানে জঙ্গিবিরোধী অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও শালিস কেন্দ্র’র হিসেব অনুযায়ী ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ১০টি অভিযান চালায়, যেসব অভিযানে নারী, শিশু ও পুরুষসহ ৩৫ জন নিহত হয়। তবে নিহতদের মধ্যে ১৪ জন আত্মঘাতী হয়েছে বলে দাবি করে পুলিশ।
প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার পদত্যাগ
২০১৭ সালের আরেক আলোচিত ঘটনা ছিল প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার পদত্যাগ। মূলত প্রধান বিচারপতি ও সরকারের টানাপোড়েন শুরু হয় সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে। অসদাচরণ ও অযোগ্যতার কারণে সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণ করার ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে দেওয়ার বিষয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে রায় দেয় আপিল বিভাগ। জুলাই মাসে ঘোষিত এ রায়ের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয় পহেলা আগস্ট। আদালতের রায়ের ৯ দিন পর সরকারের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করা হয়, যা নজিরবিহীন। সেই সংবাদ সম্মেলনে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আপিল বিভাগের রায়ে প্রধান বিচারপতির মন্তব্য ও পর্যবেক্ষণ নিয়ে স্পষ্টত অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এসব টানাপোড়েনের এক পর্যায়ে আইনমন্ত্রী বিবিসিকে জানান, বিচারপতি এসকে সিনহা তাকে জানিয়েছেন যে তিনি ক্যান্সারের রোগী। এরপর জানা যায়, প্রধান বিচারপতি ছুটিতে যাচ্ছেন। তবে দেশত্যাগের আগে বিচারপতি সিনহা সাংবাদিকদের হাতে তার কিছু লিখিত বক্তব্য দিয়ে যান, যা সরকারের বক্তব্যের সাথে পুরোপুরি অসঙ্গতিপূর্ণ। সেইসাথে তিনি অসুস্থ নন বলেও জানান এসকে সিনহা। পরবর্তীতে সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশনে তাঁর পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার খবর জানা যায়।
নিখোঁজ বা গুমের আতঙ্ক
২০১৭ সালে বাংলাদেশের জন্য আরেক আতঙ্কের কারণ ছিল নিখোঁজ বা গুমের ঘটনা। সে বছর নভেম্বরে নিখোঁজ হন বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোবাশ্বার হাসান। পরে তাঁকে খুজে পাওয়া যায়। এর আগে জুলাই মাসে কবি, কলামিস্ট, প্রবন্ধকার ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফরহাদ মজহারকে ভোর থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানায় তার পরিবার। ঢাকার শ্যামলির বাসা থেকে ভোর ৫টার দিকে একটি ফোন পেয়ে ফরহাদ মজহার বেরিয়ে যান বলে জানান তার স্ত্রী ফরিদা আখতার। পরে তেশরা জুলাই রাতে তাকে যশোর থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। এদিকে মানবাধিকার সংস্থা অধিকার জানায়, ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৮০ জন নিখোঁজ হয়েছেন।
প্রথম পর্বে উঠে এসেছে মৌলিক যে বিষয়গুলো
নিবন্ধের প্রথম পর্বে মূল যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে তা হলো, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর দীর্ঘ প্রবাসজীবন শেষে শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন, খালেদা জিয়ার সঙ্গে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন ও অতীতের ভুল-ভ্রান্তির জন্য ক্ষমা চাওয়ার প্রেক্ষাপটে ১৯৯৬ সালে তিনি প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় আসেন। তাঁর শাসনামলে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার, গঙ্গার পানি চুক্তি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি সম্পন্ন হয়। তবে দলীয়করণ ও রাজনৈতিক সংঘাত বাড়ে। পরবর্তী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয় ও বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকারের ২০০১–২০০৬ মেয়াদে সহিংসতা, শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা, দুর্নীতির অভিযোগ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে সংকট দেশের রাজনীতিকে আরও অস্থির করে তোলে।
এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে রাজনৈতিক অচলাবস্থা, পল্টনে সহিংসতা ও প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণে বিচারপতি কেএম হাসানের অপারগতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে দেশে অস্থিরতা বাড়ে। পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে সরকার গঠন ও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘাত তীব্র হয়, যা ২০০৭ সালের জরুরি অবস্থার পথ প্রশস্ত করে। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দুর্নীতি বিরোধী অভিযান, গ্রেপ্তার, পরে মুক্তি এবং ২০০৮ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে ফের ক্ষমতার মসনদে বসেন শেখ হাসিনা। ২০০৯ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক, সহিংস, বিচারিক ও সামাজিক ঘটনাপ্রবাহ, পিলখানা হত্যাযজ্ঞ, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার, হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা, গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নিখোঁজ-বিচারহীনতা, নির্বাচনী বিতর্ক ও রোহিঙ্গা ঢল বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
About the Author
Shahedur Rahman is the Op-Ed-Editor of The Insighta and a media professional with over 17 years of experience in journalism and editing. He can be reached at rahmankazishahedur@gmail.com
Disclaimer: The views expressed in this article are the author’s own and do not necessarily reflect The Insighta’s editorial stance. However, any errors in the stated facts or figures may be corrected if supported by verifiable evidence.


