ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাঃ কোথায় দাঁড়িয়ে, কি করণীয় (পর্ব-১)
আমাদের দেশের শিক্ষা ও গবেষণার মান উন্নত বিশ্ব দূরে থাক, প্রতিবেশী দেশগুলোর সমকক্ষও নয়। একটি শক্তিশালী ও মর্যাদাসম্পন্ন রাষ্ট্র গঠনে উচ্চশিক্ষার কাঠামোগত পরিবর্তন অপরিহার্য।
Bangladesh must modernize its education system to meet international standards, tackle challenges, and ensure sustainable development. Currently, it lags behind even neighboring countries like India and Pakistan. A fundamental transformation of higher education is essential for the country to gain global recognition and respect.
একটি দেশের প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক টেকসই উন্নয়নের জন্য সেই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার যুগোপযোগী উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই। শিক্ষা ব্যবস্থার অত্যাধুনিকায়ন ছাড়া সাময়িকভাবে স্বল্পকিছু উন্নয়ন সম্ভব হলেও ভবিষ্যত পৃথিবীর নানামুখী প্রতিযোগীতার দৌড়ে অবশ্যই গবেষণাধর্মী, সৃষ্টিশীল এবং সমস্যা সমাধানে পারদর্শী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রয়োজন। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ৫ম শিল্প বিপ্লবের সময়ে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা কি যুগোপযোগী? আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কি আধুনিক বা ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত? সামনের দিনগুলোতে উন্নয়নে বা আবিস্কারে নেতৃত্ব দিতে না পারলেও (যেহেতু এক্ষেত্রে আমরা বর্তমানে অনেক পিছনে আছি) অন্ততঃ উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মেলাতে দরকারি যোগ্যতা বা দক্ষতা সৃষ্টিতে আমরা কি সর্বাত্মকভাবে তৈরি?
এখানে আমরা দেশের শিক্ষার বর্তমান অবস্থা ও সার্বিক পর্যালোচনা করে উপরের প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করব। যদি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উত্তর ‘না’ হয় তাহলে ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের করনীয় কি তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করব।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা বর্তমানে কোথায় দাঁড়িয়ে?
বর্তমানে সারা বিশ্বে তথ্য ও প্রযুক্তিতে অনেক আবিস্কার ও নানা ধরনের উন্নতি হয়েছে। নিত্যনতুন আবিস্কারের মাধ্যমে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব শেষ হয়ে এখন ৫ম শিল্প বিপ্লব শুরু হয়েছে এবং ভবিষ্যৎ পৃথিবীর দিকনির্দেশনা ঠিক করছে। সমস্ত বিশ্ব এই ৫ম শিল্প বিপ্লবের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে বা বিপ্লবকে এগিয়ে নিতে শিক্ষাক্ষেত্রকেও পরিবর্তন, পরিযোজন ও উন্নতি করছে। উদাহরণ হিসাবে আমরা সৌদি আরব বা মালয়েশিয়ার নাম উল্লেখ করতে পারি। সৌদি আরব গত কয়েক বছর ধরে রুপান্তরকারী (Transformative) ও যুগান্তকারী পরিবর্তনের মধ্যে আছে। এই পরিবর্তন ও অগ্রগতির শুরুতেই তারা শিক্ষা খাতকে ঢেলে সাজিয়েছে এবং শিক্ষা খাতে ভিশন-২০৩০ নির্ধারন করেছে। মালয়েশিয়াও ‘Education Blueprint 2025’ এর আলোকে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করেছে যাতে তারা আধুনিক বিশ্বের অগ্রগতির সাথে খাপ খাওয়াতে পারে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই ‘কবির চৌধুরি শিক্ষা কমিশন ২০০৯’ গঠন করে। তার আলোকে গত ১৫ বছরে শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রভূত পরিক্ষা-নিরিক্ষা চালানো হয়েছে । এই পরিক্ষা নিরিক্ষা চালাতে গিয়ে এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষাখাতের ন্যাক্কারজনক ও লজ্জাজনক ব্যবহারের ফলে শিক্ষা খাতে অপরিসীম ক্ষতি করে ফেলেছে। বিশেষ করে, পাসের হার বাড়াতে পরিক্ষার মান কমানো ও ‘জোর করে’ সবাইকে পাস করিয়ে দেয়ার ফলে শিক্ষার গুনগত মানে বড় ধরণের ক্ষতি সাধন হয়েছে। এর পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লাগামছাড়া ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি, ছাত্রদেরকে ছাত্র-শিক্ষকদের লাঠিয়াল বাহিনি হিসাবে ব্যবহার, এবং শিক্ষক হিসেবে অযোগ্য দলীয় কর্মীদের নিয়োগের ফলে উচ্চ শিক্ষার পরিবেশ ও মানে ভয়াবহ অবনমন হয়েছে।
এখন আমরা যদি তুলনামূলক অধ্যয়নের মাধ্যমে দেখতে চাই যে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা বিশ্বের অন্যান্য দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার তুলনায় কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, তাহলে দেখব- একটি দেশের সার্বিক শিক্ষা ক্রমে ২০৩ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২২ তম । আরেকটি সমীক্ষা অনুসারে ৮৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৩তম।‘Data Pandas’ এর রিপোর্টে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৬ তম যেখানে ১৭৭ টি দেশের মধ্যে তুলনা করা হয়েছে। বিভিন্ন সংস্থার উপরিউক্ত রিপোর্ট গুলোতে আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার দৈন্যদশাই প্রমাণ করে। যার প্রভাব স্বাভাবিক ভাবেই পড়েছে আবিস্কার ও উদ্ভাবনে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে আমাদের দেশ উদ্ভাবন ও আবিষ্কারের তালিকাতেও যথারীতি তলানীতে। ১৩৩ টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১০৬-এ । অর্থাৎ আমরা তেমন কিছুই আবিস্কার করতে পারিনি বা পারিনা। এক্ষত্রে হয়ত যুক্তি আসতে পারে যে বাংলাদেশ দরিদ্র দেশ- আমাদের গবেষণা করতে যে অর্থ প্রয়োজন সে অর্থের যোগান আমাদের নেই। কিন্তু আমরা যদি ‘Input-Output’ বা একটি দেশের অর্থনৈতিক ক্ষমতার সাপেক্ষে (নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, ও উচ্চবিত্ত দেশ) উদ্ভাবনের সক্ষমতা দেখি তাহলে দেখা যায় যে নিম্নমধ্যবিত্ত ক্যাটাগরিতে (বাংলাদেশ এই শ্রেণীতে পড়ে) প্রথম তিনটি দেশ যথাক্রমে ইন্ডিয়া, ভিয়েতনাম, এবং ফিলিপাইন। বাংলাদেশ এই ক্যাটাগরির ৩৮টি দেশের মধ্যে ২২ তম।
বর্তমান সরকারের অবস্থান ও দিক নির্দেশনা, এবং জরুরী করণীয়
বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের দেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদি, কার্যকরি ও রুপান্তরকারি (Transformative) একটা শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারের পরিকল্পনা অতীব জরুরী। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত আগস্ট বিপ্লবের প্রেক্ষিতে সরকার পরিচালনার ক্ষমতা লাভের পরে দেশ সংস্কারের উদ্দেশ্যে ছয়টি কমিশন গঠন করে। এই কমিশনগুলোর কয়েকটি রিপোর্ট ইতোমধ্যে প্রকাশ হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল এই ছয়টি কমিশনের মধ্যে শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারের কমিশন নেই। অর্থাৎ সরকার ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করলেও দেশ সংস্কারের জন্য শিক্ষা খাতে নজর দেয়াকে জরুরি মনে করেনি। হয়ত তাদের হাতে সময় ও আনুষঙ্গিক ব্যবস্থার স্বল্পতা ছিল বা আছে। কিন্তু, যেহেতু বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপর সারা দেশের জনগণের অপরিসীম প্রত্যাশা, সেহেতু সরকারকে এই দিকে বেশি নজর দেয়া প্রয়োজন।
বিশেষ করে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের পদ্ধতি পরিবর্তন করে বৈশ্বিক মানদন্ডে উন্নত করা খুব জরুরি ছিল যা এখনো বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। এটা বাস্তবায়ন করা খুব বেশি কষ্টসাধ্যও ছিলনা। অন্ততঃ বর্তমান সরকার এই উদ্যোগ শুরু করতে পারত। আরেকটি গুরুত্বপুর্ন বিষয় হলো শিক্ষা সেশনের কার্যক্রমের মধ্যে এমনভাবে সমন্বয় করা যেন প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত একটা সমন্বিত (Concerted) সূচি করা যায় যা আন্তর্জাতিক শিক্ষা কার্যক্রমের সাথেও তাল মেলাবে। কিন্তু, সরকারের মধ্যে এ ধরনের কোন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছেনা; এমনকি আমরা এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোন আলোচনার উদ্যোগও দেখতে পাচ্ছিনা।
অত্যাধুনিক ও টেকসই উন্নয়নে সর্বাঙ্গীন পর্যালোচনা
উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ছাড়া বাংলাদেশের সামগ্রিক, দীর্ঘমেয়াদি এবং টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। তড়িঘড়ি করে বা জোড়াতালি দিয়ে কিছু পরিবর্তন করলে তার ফল স্বল্পমেয়াদে পাওয়া গেলেও দীর্ঘমেয়াদে ভালো কিছু হয়না। দীর্ঘমেয়াদি এবং টেকসই উন্নয়ন করতে গেলে আগে আমাদেরকে সমস্যার মূল খুঁজে বের করতে হবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে- সমস্যা কোথায়? আমাদের কি শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কোন পরিকল্পনা নেই? দেশে তো শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, এবং বেশ কিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাহলে কেন শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান তলানিতে? কোনো সরকার কি শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ গ্রহণ করেনা বা গ্রহণ করলেও বাস্তবায়ন করতে পারে না? নাকি ইচ্ছা করেই বাস্তবায়ন করেনা?
উল্ল্যেখ্য, স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত ছয়টি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা কমিশন এবং দুইটি অন্তর্বর্তিকালিন আধা-কমিশন গঠিত হয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী সরকারের আমলে তিনটি কমিশন গঠিত হয়ঃ ১৯৭২ সালে কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন, ১৯৯৭ সালে প্রফেসর এম শামসুল হক শিক্ষা কমিশন, এবং ২০০৯ সালে কবীর চৌধুরী শিক্ষা কমিশন। বিএনপির আমলে ২০০১ সালে এম.এ. বারী কমিশন এবং ২০০৩ সালে মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিয়া কমিশন গঠিত হয়। তাছাড়া ১৯৮৮ সালে এরশাদ সরকারের আমলে মফিজ উদ্দিন শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। ১৯৭৮ এবং ১৯৮৩ সালে ২টি অপূর্ণাঙ্গ কমিশন গঠিত হয় যথাক্রমে কাজী জাফর আহমেদ এবং মাজিদ খানের নেতৃত্বে।
যদিও দেশে ৮টি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে, জেলায় জেলায় স্বাধারণ ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এবং তথ্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র তৈরি হয়েছে, তবুও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানদন্ডে শিক্ষা, গবেষণা, আবিস্কার, ও উদ্ভাবনে বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে পেছনের দিকে ধাবিত হয়েছে।
এই বাস্তবতায় আমরা প্রথমে শিক্ষা ব্যবস্থার সমস্যা ও তার সমাধান, এবং পরবর্তিতে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিক্ষা ব্যবস্থাকে যথাযথ ভাবে গড়ে তুলতে কিছু সুপারিশ উত্থাপন করব।
সমস্যা চিহ্নিত করতে আমরা কয়েকটি দিকে নজর দিব-
১। শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ ও কারিকুলাম পর্যালোচনা।
২। রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বিভিন্ন সরকারের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি পর্যালোচনা
৩। অর্থনৈতিক বাস্তবতা পর্যালোচনা
৪। সামাজিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ
About the Author:
মহব্বত আলী, পি.এইচ.ডি. বেলব্রুক ল্যাব, ম্যাডিসন, উইসকন্সিন -এ সিনিয়র সাইন্টিস্ট (।।), আর এন্ড ডি তে কর্মরত আছেন। এর পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সামজিক, ও রাজনৈতিক শিক্ষা ও গবেষণার সাথে জড়িত। He can be reached at mahbbatali10@gmail.com
Disclaimer: The views expressed in this article are the author's own and do not necessarily reflect The Insighta's editorial stance. However, any errors in the stated facts or figures may be corrected if supported by verifiable evidence.