নগদ নেই, দুর্নীতি নেই
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দুই বাস্তবতা- গরিবের হাতে লুকানো নগদ, ধনীর পুঁজি বিদেশে। আধুনিক প্রযুক্তি ও ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে উন্নয়নগল্প স্বত্ত্বেও দেশ রয়ে গেছে নগদনির্ভর, যেখানে আর্থিক স্বচ্ছতা এখনো অধরা।
Bangladesh’s economy runs on contradictions—the poor hide cash, the rich move it abroad. Despite flashy digital slogans, banking remains slow, opaque, and resistant to reform. “Cashless Bangladesh” is still more illusion than reality.
বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো নগদনির্ভর। গরীবের হাতে ভাঁজ করা টাকা, ধনীর অর্থ বিদেশে পাচার। ব্যাংকিং সিস্টেমে ডিজিটাল অগ্রগতির গল্প থাকলেও বাস্তবতা শামুকগতির অ্যাপ আর সীমিত প্রতিযোগিতা। দেশের ৩০-৪০ শতাংশ অর্থ এখনো করবিহীন কালো লেনদেনে ঘুরছে। নগদ লেনদেনের প্রতি ধনী ও প্রভাবশালী শ্রেণি বেশি আগ্রহী, যা আর্থিক জবাবদিহিতা ও কর এড়ানোর প্রবণতাকে স্পষ্ট করে। ভারত ও ইন্দোনেশিয়া যেখানে প্রযুক্তিনির্ভর স্বচ্ছ লেনদেনে এগিয়েছে, বাংলাদেশ সেখানে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও আস্থার ঘাটতিতে পিছিয়ে রয়েছে। দেশে ‘ক্যাশলেস ইকোনমি’ বা ‘নগদবিহীন অর্থনীতি’ নিয়ে সম্প্রতি এক ফেসবুক পোস্টে এমন অভিমত প্রকাশ করেছেন ইন্সটিটিউট অব কস্ট এন্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ-এর প্রেসিডেন্ট মাহতাব উদ্দিন আহমেদ। তাঁর পোস্টটি এখানে হুবহু তুলে ধরা হলো।
বাংলাদেশে টাকা চলে দুই সমান্তরাল জীবনে। গরিব কৃষকের জন্য সেটা থাকে লুঙ্গির ভাঁজে, বালিশের নিচে, অথবা ভাতের হাঁড়ির ‘পবিত্র’ কোনায়, কারণ ব্যাংক কিসের দরকার, যখন ঘরে ঈশ্বর আছেন! অন্যদিকে ধনী ভদ্রলোকরা (পড়ুন: রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক প্রভাবশালী মহল) এত সরল নন। তাদের টাকা প্রথম ফ্লাইটেই চড়ে বসে, দুবাই, সিঙ্গাপুর, লন্ডন, শুধু বাংলাদেশ বাদে সবখানে। ফলাফল? দেশের অর্ধেক মানুষ নগদের ওপর ঘুমাচ্ছে, আরেক অর্ধেক নিশ্চিত করছে দেশটাই যেন সর্বস্বান্ত থাকে।
এবার আসি সংখ্যায়। মাত্র ৩৫ শতাংশ বাংলাদেশির হাতে আছে আর্থিক হিসাবে প্রবেশাধিকার, যেখানে ভারতে তা ৮০ শতাংশ আর চীনে ৯৫ শতাংশ। মোবাইল আর্থিক সেবা (এমএফএস) ভালোই বাড়ছে, তবে বেশিরভাগই গাজীপুরের ছেলে রংপুরের মাকে পাঁচশো টাকা পাঠানোর কাজে, মূলধারার ব্যাংকিংয়ের বিকল্প হিসেবে নয়। ব্যঙ্গাত্মক হলেও সত্য, চারশো পঞ্চাশ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি এখনো কুঁচকানো টাকার নোটে চলছে। কেন? কারণ দেশীয় উৎপাদনের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ সমান বিশাল কালো অর্থনীতি এখনো নগদের জোরে ফুলেফেঁপে উঠছে। নেই কোনো রসিদ, নেই কোনো কর, শুধু একরাশ ‘ভাব’।
আমাদের ব্যাংকগুলো ডিজিটাল হওয়ার গল্প বলে, এমনকি ডিজিটাল ব্যাংকের অনুমতি পেতে ছুটে যায়, অথচ বাস্তবে চলে এমন অ্যাপে যেগুলো ঢাকার বৃষ্টির দিনে ইন্টারনেটের চেয়েও ধীর। শাখাগুলো আবার ডুবে আছে গ্রাহকের বয়সের চেয়েও পুরনো কাগজপত্রে। এরপর আসে মোবাইল আর্থিক সেবার একচেটিয়া আধিপত্য। একজন প্রতিষ্ঠান সত্যিই অনেক ভালো করেছে, কিন্তু যখন একজনই বাজারের majority দখল করে, প্রতিযোগিতা আর উদ্ভাবন শুকিয়ে যায়।
সত্যিকারের নগদবিহীন অর্থনীতি মানে হলো সব লেনদেন অনুসরণযোগ্য; প্রতিটি লেনদেন কর বিভাগের জন্য রুটির টুকরো। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কালো টাকায় মজে থাকা ব্যবসায়ী আর রাজনৈতিক অভিজাতরা কি স্বেচ্ছায় নিজেদের অর্থের খাতা খুলে দেবে? সেটা তো ঠিক বিড়ালকে জিপিএস কলার পরাতে বলার মতো, শুনতে মজা, বাস্তবে অসম্ভব।
ভারত, তার বিশৃঙ্খলার মধ্যেও, ২০১৬ সালে নোটবন্দি করে ইউনিফায়েড পেমেন্টস ইন্টারফেস (ইউপিআই)-কে এমন এক শক্তি দিয়েছে যে এখন মাসে ১৪ বিলিয়ন লেনদেন হয়। ইন্দোনেশিয়া আবার তৈরি করেছে বহুমাত্রিক ডিজিটাল প্রদেয় ব্যবস্থা, যেখানে এক বা দুই প্রতিষ্ঠানের বাইরে নতুনত্ব আর ভোক্তার বিকল্পও আছে। তারা আগেই বুঝে নিয়েছে, নগদবিহীন মানে শুধু মোবাইল অ্যাপ নয়, এটা হলো দায়বদ্ধতা, আস্থা, আর রাজনৈতিক সদিচ্ছা; যেটা ঢাকায় সময়মতো ট্রেন পাওয়ার চেয়েও বিরল।
নগদ কোনো ছাপ ফেলে না, না ভ্যাট, না কর, না বিব্রতকর প্রশ্ন। সুবিধার জন্য নয়; অদৃশ্য থাকার জন্যই নগদকে এত ভালোবাসা। আমি নিজ চোখে দেখেছি: ধনী ব্যবসায়ীরা হোটেল বা বাজারের বিল গুনে গুনে নগদে দিচ্ছেন, কার্ডের সহজ সুবিধা উপেক্ষা করে। আবার এক প্রভাবশালী সরকারি প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ ব্যক্তি, সেবার জন্য নয়, দুর্নীতির জন্যই বেশি পরিচিত, কখনো ক্রেডিট কার্ড ছোঁয় না, এমনকি বিদেশ সফরেও নয়। স্থানীয় অনেক করপোরেটও কর্মীদের বেতন দেয় অর্ধেক নগদে, অর্ধেক ব্যাংকের হিসাবে, যাতে সবকিছু ঝাপসাই থাকে। সব মিলিয়ে মনে হয়, আমরা নগদবিহীন হওয়ার পথে নই; বরং গর্ব করে “নগদপূর্ণ” অর্থনীতিতে উল্টো গিয়ার মেরেছি।
এদিকে উন্নত দেশগুলো নগদ আর কার্ড দুটোই ছাড়িয়ে গেছে। অ্যাপল পে, গুগল পে, মুখের পরিচয় শনাক্তকরণ, কার্ড সোয়াইপ এখন সেকেলে। আর আমরা প্লাস্টিক কার্ডে টোকা দিয়ে মনে করছি আধুনিকতার চূড়ায় উঠেছি। যদি বাংলাদেশ লাফিয়ে এগোতে চায়, তবে চাই সাহসী সংস্কার, একীভূত ব্যবস্থা, ডিজিটাল পরিচয় সংযুক্তি, ডিজিটাল লেনদেনে কর ছাড়, আর সর্বোপরি সেই রাজনৈতিক সাহস যা নগদের রাজাদের রুষ্ট করতে পারে।
বাংলাদেশের হাতে উপকরণ আছে, যুব জনসংখ্যা, মোবাইল প্রবেশ, আর বাড়ন্ত অর্থনীতি। যা নেই তা হলো নগদ-ভিত্তিক দুর্নীতির সোনার ডিম পাড়া হাঁসটিকে জবাই করার ইচ্ছা। ততদিন পর্যন্ত আমরা দেখতে থাকব দুই বাংলাদেশকে, একজন লুঙ্গিতে টাকা লুকাচ্ছে, আরেকজন লন্ডনে পাচার করছে। সত্যিকারের নগদবিহীন বাংলাদেশ সম্ভব, তবে এর জন্য আমাদের নেতাদের ছাড়তে হবে তাদের প্রিয় শখ: সম্পদ লুকানোকে জাতীয় খেলা বানানো।
আর এ কারণেই cashless বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা এত জরুরি। এটা শুধু নীতি বিতর্ক নয়; এটা পরীক্ষা, আমরা কি নগদ-ভারাক্রান্ত বিশৃঙ্খলা থেকে নগদবিহীন স্বচ্ছতায় যেতে চাই? ততদিন পর্যন্ত কৌতুকটা আমাদের নিয়েই, আমাদের অর্থনীতি নগদবিহীন (cashless) নয়, বরং পুরোপুরি বোকাসোকা।
বাংলাদেশ নগদেই চলে: গ্রামবাসী জমায়, ধনী পাচার করে, ব্যবসায়ী শপথ নেয় নগদের ওপর। ব্যাংক প্রতিশ্রুতি দেয় ডিজিটাল স্বপ্নের, কিন্তু দেয় শামুকগতির অ্যাপ, আর করপোরেট এখনো বেতনের অর্ধেক খামে ঢুকিয়ে দেয়। এদিকে দুনিয়া মোবাইলে টোকা দিচ্ছে, আমরা এখনো নোটে গুনছি। নগদবিহীন বাংলাদেশ? ভালো স্লোগান। বাস্তবতা হলো, আমরা গর্বের সঙ্গে নগদপূর্ণ, সৃজনশীলভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত, আর নিরাশভাবে বোকাসোকা।
About the Author:
The writer Mahtab Uddin Ahmed is the president of the Institute of Cost and Management Accountants of Bangladesh and founder of BuildCon Consultancies.
Disclaimer: The views expressed in this article have originally been published to authors’ social media handle precisely in Facebook. The author communicated before publishing this article here. The comment and views are the author’s own and do not necessarily reflect The Insighta’s editorial stance. However, any errors in the stated facts or figures may be corrected if supported by verifiable evidence.