আইপিএলের ‘দামি খেলোয়াড়’ মিডিয়ার ‘আইপিএলীয়’ ন্যারেটিভ
আইপিএল শুধু ক্রিকেট টুর্নামেন্ট নয়, বরং মিডিয়া-নির্ভর এক বর্ণিল ন্যারেটিভ, যেখানে ‘দামি খেলোয়াড়’ তকমা এক কৌশলগত আকর্ষণ।
How does IPL turn cricketers into high-priced media products? This article unpacks the spectacle, strategy, and narrative-making behind the "most expensive player" in the IPL auction economy.
২০২৪ সালের নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে আইপিএল মেগা নিলাম-পরবর্তীতে কমবেশি সকলের আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল, নিলামে সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হওয়া খেলোয়াড় কে? ২০০৮ সালে ফ্র্যাঞ্চাইজি-নির্ভর এই টি-২০ লিগ শুরু হওয়ার পর ক্রিকেট খেলুড়ে বিভিন্ন দেশেও একই মডেলে লিগ খেলা শুরু হয়। যেমন: বাংলাদেশে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল), অস্ট্রেলিয়ায় বিগ ব্যাস লিগ (বিবিএল), পাকিস্তানে পাকিস্তান প্রিমিয়ার লিগ (পিএসএল) প্রভৃতি। কিন্তু এগুলোর কোনোটার নিলাম-পরবর্তীতে ‘সর্বোচ্চ দামি খেলোয়াড়’- সংক্রান্ত কোনো সংবাদ মিডিয়ায় চোখে পড়ে না। থাকলেও সংবাদের শিরোনামগুলো হয় একটু ভিন্ন ধরনের; যেমন: ‘ড্রাফটে সর্বোচ্চ দামি খেলোয়াড়’, ‘সর্বোচ্চ দামি ক্যাটাগরিতে খেলোয়াড়’, কিংবা ‘ড্রাফটে সবচেয়ে দামি ক্যাটাগরিতে খেলোয়াড়’।
প্রশ্ন আসাটা খুবই স্বাভাবিক—কেন এই পার্থক্য? কেবল এটাই না, যারা আইপিএলের গত নিলামের সংবাদ পড়েছেন, কিংবা লাইভ দেখেছেন তারা জানেন যে ভারতের শ্রেয়াস আয়ারকে পাঞ্জাব কিংস সর্বোচ্চ দাম দিয়ে কেনার পর ২০ মিনিটেরও কম সময় তিনি আইপিএলের ইতিহাসে ‘সর্বোচ্চ দামি খেলোয়াড়’ ছিলেন। এরপরই ভারতের বর্তমানে সর্বাধিক আলোচিত ক্রিকেটার ঋষভ পন্ত আইপিএলের ইতিহাসের ‘সর্বোচ্চ দামি খেলোয়াড়’ হন। তাকে লক্ষ্ণৌ সুপার জায়ান্টস ২৭ কোটি রুপিতে কিনে নেয়। প্রশ্ন ওঠে, কিসের ভিত্তিতে একটা ফ্র্যাঞ্চাইজি একজন খেলোয়াড়কে এতো দাম দিয়ে কিনলো? এর মাধ্যমে দলের কী কোনো লাভ-ক্ষতি আছে? আইপিএল আসলে কী? এটা কি শুধুই ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড আয়োজিত বাৎসরিক কোনো টুর্নামেন্ট? নাকি এটা মারকাটারি ক্রিকেটের প্যাকেটে মোড়ানো এক বিশাল বাণিজ্যিক পণ্য, যেটাকে ক্রিকেটপাগল কোটি কোটি ভারতীয়র সামনে উপস্থাপন করা হয় মিডিয়া ন্যারেটিভ হিসেবে?
২০০৮ সালে আইপিএলের আবির্ভাবের মাধ্যমে ক্রিকেটবিশ্ব প্রথমবারের মতো ফ্র্যাঞ্চাইজি-নির্ভর ক্রিকেট টুর্নামেন্টের সাথে পরিচিত হয়। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড আটটি ফ্র্যাঞ্চাইজি বিক্রি করে আটজন ফ্র্যাঞ্চাইজারের কাছে। বিশ্বক্রিকেটের এক ঝাঁক নামিদামী তারকা কে কোন দলে খেলবেন-তা নির্ধারণ করতে ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আয়োজিত হয় নিলাম। লাখ লাখ দর্শক টিভি স্ক্রিনে দেখলেন, ক্রিকেট তারকাদের দলে ভেড়াতে কর্পোরেট জগতের তারকা আর বলিউডের তারকারা নিলামের ডাক দিচ্ছেন! বিজনেস টাইকুন, বিনোদন আর ক্রিকেট জগতের সংমিশ্রণে এটা যেন সরাসরি সম্প্রচারিত চিত্রনাট্য হয়ে উঠলো।
ক্রিকেট হয়ে ওঠে লাইভ সিনেমা!
আসলে আইপিএল বললেই যেন আমাদের চোখে ভেসে ওঠে চার-ছক্কার ধুন্ধুমার ক্রিকেটের পাশাপাশি বৈচিত্র্যময় নানা রঙ ও রূপের মেলা! স্টেডিয়ামের দর্শক থেকে শুরু করে চিয়ার লিডার প্রত্যেকেই বর্ণিল রঙে রঙিন! দর্শকরা তাদের পছন্দের দলের জার্সির অনুরূপ জার্সি পরেন। একইভাবে চিয়ার লিডাররাও খেলায় অংশ নেওয়া দুই দলের জার্সি-কেন্দ্রিক রঙ বাছাই করে মেকআপ নেন। ফ্লাডলাইটের নিচে স্টেডিয়ামের বর্ণিল আলোকসজ্জা অভিভূত করে ক্রিকেটপ্রেমিদের। টিভি স্ক্রিনে যতদূর চোখ যায়, পুরোটাই রঙিন বিজ্ঞাপনের দখলে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আইপিএলের জৌলুসও বেড়েছে বহুগুণে। আইপিএলের পঞ্চম আসর, ২০১২ সাল থেকে ক্রিকেটারদের জুতাও রঙিন করা হয়। ২০১৬ সালে দেখা গেল অভিনব এক সংযোজন। আইপিএলের নবম আসরে বিরাট কোহলি, গৌতম গম্ভীর, যুবরাজ সিং, ডেভিড ওয়ার্নার প্রায় কমবেশি সবারই দুই পায়ে ছিল ভিন্ন ভিন্ন রঙের জুতা! খেলা শুরুর আগমুহূর্তে খেলোয়াড়দের মাঠে প্রবেশের সময় মিউজিক, আতশবাজি সবাইকে উদ্বেলিত করে তোলে। খেলার মাঝে শাহরুখ খান, প্রীতি জিনতার মতো বলিউড সুপারস্টারদের উপস্থিতি-- ভক্ত-অনুরাগীদের যেন টেলিভিশনের পর্দা ছেড়ে একচুলও নড়তে দেয় না! তাহলে পুরো বিষয়টা কী দাঁড়ালো? পুরো আইপিএল কাঠামোটাকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যেন দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণ করা যায় সহজেই। নিলাম যেন ‘নতুন পর্বের সম্ভাব্য সেরা ট্রেলার’ নিলামে মূলত একজন খেলোয়াড়ের বেস বা ভিত্তি মূল্যের সাথে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো বিভিন্ন খেলোয়াড়দের জন্য দাম হাকেন, এবং এদের মধ্যে যিনি সর্বোচ্চ দিতে রাজি হন, তিনি ওই নির্দিষ্ট খেলোয়াড়কে তার দলে ভেড়াতে পারেন। আর এটা উক্ত খেলোয়াড়ের সেই মৌসুমের বেতন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, এই ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর মালিক হলেন ভারতের সর্বোচ্চ ধনী ব্যবসায়ী এবং বলিউডের তারকারা। আর তাদেরকেই আমরা টেলিভিশনের পর্দায় দেখি ক্রিকেট তারকাদের নিয়ে নিলাম যুদ্ধে লিপ্ত হতে! আইপিএলের উদ্ভাবক ব্যবসায়িক পরিবারের সন্তান ললিত মোদির ভাষায়, ‘নিলাম হলো নতুন পর্বের সম্ভাব্য সেরা ট্রেলার’।
খেলোয়াড় শুধু ম্যাচ-উইনার নয়, বরং স্পন্সর-প্রিয়ও হতে হবে
আলোচনা সাপেক্ষে এটা বোধগম্য যে খেলোয়াড় নির্বাচনের এই নিলাম প্রক্রিয়ায় দুইটা বিষয় কাজ করে: ১। ফ্র্যাঞ্চাইজি শুধু ম্যাচ জয়ের জন্যই খেলোয়াড় নির্বাচন করেন না। বরং তারা স্পন্সরদের কথা বিবেচনায় নিয়ে ক্রিকেটারের সাথে ব্র্যান্ডের উপরও বিনিয়োগ করেন। ২। আর এই বিনিয়োগ, অর্থাৎ খেলোয়াড়ের মূল্য নির্ধারিত হয় বাজারের চাহিদা, ফ্র্যাঞ্চাইজির প্রয়োজন ও যোগানের উপর।
বিষয়টা ব্যাখ্যা করলে সহজ হবে। প্রথমতঃ ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর আয়ের বড় একটা উৎস হলো মিডিয়া স্বত্ত্ব, যেটা আইপিএল কর্তৃপক্ষ বিক্রি করেন সম্প্রচারকারী টেলিভিশন চ্যানেল এবং অনলাইন স্ট্রিমারদের কাছে। এটা থেকে যে অর্থ আসে, সেটা ভাগ হয় ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর মধ্যে। এক্ষেত্রে লিগ টেবিলে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর অবস্থানটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অর্থাৎ, রাউন্ড রবিন পদ্ধতিতে হওয়া খেলায় লিগ থেকে বাদ পড়ে যাওয়া দলগুলো মিডিয়া স্বত্ত্ব বাবদ যে অর্থ পায়, তার চেয়ে বেশি অর্থ পায় প্লে-অফ খেলা দলগুলো। আর ফাইনালে খেলা দল দু’টি পায় সর্বাধিক অর্থ।
দ্বিতীয়তঃ ফ্র্যাঞ্চাইজির প্রয়োজন ও যোগান কী? খুব স্বাভাবিকভাবেই এক ঝাঁক তারকা খেলোয়াড় থেকে একটা দল সেরা একাদশটাই বাছাই করতে চায়। এক্ষেত্রে দলটি সর্বমোট ২৫ জন এবং সর্বনিম্ন ১৮ জন খেলোয়াড় নির্বাচন করতে পারে। এখন এই দলটির একাদশের জন্য প্রয়োজন দ্রুতগতির বোলার, স্পিনার, বিভিন্ন অর্ডারে খেলা ব্যাটসম্যান, উইকেটকিপার, অলরাউন্ডার, আর একজন অধিনায়ক। পূর্বের মৌসুমে খেলা কিছু খেলোয়াড়কে রিটেন করা ছাড়া বাকি খেলোয়াড়কে নিতে হয় নিলামের মাধ্যমে। বাকি খেলোয়াড়গুলো থাকে নির্দিষ্ট দক্ষতার। কোনো দলের দ্রুতগতির বোলারের ঘাটতি থাকতে পারে, কারো মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান, কারো হয়ত উইকেটকিপার কিংবা অলরাউন্ডার। এটাই হলো ফ্র্যাঞ্চাইজির প্রয়োজন। এখন ফ্র্যাঞ্চাইজির মোট অর্থ থেকে পূর্বের মৌসুমের খেলোয়াড়কে রিটেন করার পর যে অর্থ থাকে সেটা নিয়েই দলটিকে নিলাম প্রক্রিয়ায় যেতে হয়। এই অর্থটাই হলো ফ্র্যাঞ্চাইজির যোগান।
সুতরাং, নিলামের সময় ফ্র্যাঞ্চাইজির শুধু একজন ম্যাচ-উইনারই প্রয়োজন হয় না, বরং এটার পাশাপাশি খেলোয়াড় নির্বাচনের বিষয়টা স্পন্সরদের পছন্দ, দলের বাজেট, দলের প্রয়োজন এবং তাদের ফাঁকা স্পটের উপর নির্ভর করে।
ব্যতিক্রমী নিয়মে বাড়তি ড্রামা
কোটি কোটি দর্শককে চুম্বকের মতো ধরে রাখতেই আইপিএল-কর্তৃকক্ষ আন্তর্জাাতিক ক্রিকেটের নিয়মকানুন পাশ কাটিয়ে সংযোজন করেছে বিভিন্ন ধরনের ব্যতিক্রমী অনুষঙ্গ। ওয়াইড, নো বলে রিভিউ নেওয়া, এক ওভারে বোলারের দু’টা বাউন্সার দেয়ার সুযোগ প্রভৃতি।
নিলামে আছে রাইট টু ম্যাচ কার্ড। এর মাধ্যমে আইপিএল দলগুলোকে তাদের ষষ্ঠ খেলোয়াড় ধরে রাখার সুযোগ দেয়। এর ফলে প্রাথমিকভাবে কোনো ক্রিকেটারকে ছেড়ে দেওয়ার পরেও নিলাম থেকে তাঁকে নেওয়ার পথ খোলা থাকে। আবার ‘ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার’ নিয়মের জন্যই এখন আইপিএলকে অনেকেই ১১ জনের পরিবর্তে ১২ জনের খেলা বলে অভিহিত করছেন। খেলার ফলাফলের পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন মনে করলে কোচ কিংবা অধিনায়ক নতুন একজন খেলোয়াড়কে মাঠে নামাতে পারেন। আরও আছে স্ট্র্যাটেজিক টাইম আউট। এটা ম্যাচ চলাকালীন সংক্ষিপ্ত সময়ের বিরতি, যা দুই ইনিংসে দুই মিনিট ৩০ সেকেন্ড করে মোট পাঁচ মিনিটের হয়ে থাকে। আপাতদৃষ্টিতে এই সময়ে খেলোয়াড়রা তাদের খেলার জন্য কিছু পরিকল্পনা করতে পারেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটা স্পন্সরদের জন্য নির্ধারিত বিজ্ঞাপনের সময়।
অর্থাৎ আইপিএল মাঠে গড়ানোর পূর্বে খেলোয়াড় নির্বাচন, নিলাম প্রক্রিয়া, খেলার অভিনব নিয়ম এবং খেলা চলাকালীন মাঠের সাজ-সজ্জা, রঙিন বিজ্ঞাপন- পুরো কাঠামোটাই দর্শককেন্দ্রিক মিডিয়া উপযোগী একটা বাণিজ্যিক পণ্য।
অতএব ‘দামি খেলোয়াড়’ মিডিয়ার ন্যারেটিভ ছাড়া আর কিছুই না!
মিডিয়ার অর্থনৈতিক কাজ হলো মুনাফা অর্জন করা। এটা করতে যেয়ে তারা সমাজের বিভিন্ন স্তরের, বিভিন্ন শ্রেণীর গল্পগুলো খুঁজে বের করে এবং গল্পগুলোকে নির্দিষ্ট মিডিয়ার ধরণ অনুযায়ী গুছিয়ে, সাজিয়ে নির্দিষ্ট অডিয়েন্সের কাছে উপস্থাপন করে। এই নির্দিষ্ট মিডিয়ার ধরণ অনুযায়ী গল্পগুলোকে উপস্থাপন করাটাই হলো ন্যারেটিভ।
ন্যারেটিভ বলতে কেবল গল্পের উম্মোচনকেই বোঝানো হয় না, বরং এর ভেতরের স্তরগুলোকেও সনাক্ত করা, স্তরগুলোর পারস্পরিক যোগসূত্রকে চিহিৃত করাকেও বোঝায়। ন্যারেটিভের অর্থ এক শব্দ থেকে আরেক শব্দে যাওয়া নয় বরং এক স্তর থেকে পরবর্তী স্তরে যাওয়াকে বোঝায়। অতএব গল্পটা বলার জন্য ন্যারেটিভের নির্দিষ্ট কিছু মানদন্ড আছে। আইপিএলকেও ন্যারেটিভের এই বাক্সের মধ্যে ফেলেই জনপ্রিয় করা হয়। এজন্যই একটা টুর্ণামেন্টকে কেন্দ্র করে নিলাম প্রক্রিয়া, অভিনব নিয়ম, খেলোয়াড়ের সাজসজ্জা, স্টেডিয়ামের সাজসজ্জা, প্রভৃতির আয়োজন করা হয়।
ঠিক একইভাবে আইপিএলের নিলামের দামি খেলোয়াড়ও এই ন্যারেটিভের মানদন্ডেরই আরেকটা অংশ। কীভাবে- এটা জানতে আমরা এবারের দামি খেলোয়াড় পন্তের বিষয়টার দিকে নজর দেবো। যেমনটা আগে উল্লেখ করা হয়েছে, পন্তকে লক্ষ্ণৌ ২৭ কোটি রুপিতে কিনে নেয় আর এতে করে পন্ত হয়ে গেলেন আইপিএলের ইতিহাসে সবচেয়ে ‘দামি খেলোয়াড়’। তাকে কেন্দ্র করে নিলামের অংশটুকুও ছিল বেশ নাটকীয়। টেলিভিশনের সামনে বসে দেখা সেই মুহূর্তের যে উত্তেজনা তা কোন শব্দ, বাক্য বা ভাষা দিয়ে হয়তো বোঝানো সম্ভব নয়, তবে সেই পরিবেশটা বর্ণনা করলে ন্যারেটিভের মানদন্ডগুলো বোঝা যায়। যাহোক, নিলামে যখন পন্তের নাম ঘোষণা করা হয়, তখন অডিয়েন্সের হাততালিতে পুরো হল সরব হয়ে ওঠে। দুই কোটি টাকার বেস প্রাইজের পন্তের জন্য শুরুতেই দর হাকে লক্ষ্ণৌ। নিলাম যুদ্ধটা শুরুই হয় রয়েল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু এবং লক্ষ্ণৌ-এর মধ্যে দর কষাকষির মাধ্যমে। এটা যেয়ে ঠেকে লক্ষ্ণৌ-এর ১১.২৫ কোটি রুপিতে। এই সময় বেঙ্গালুরু পিছু হটে যায়। পুরো সময়টা বেশ মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছিলেন পন্তের পুরোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি দিল্লি ক্যাপিটালস, যার কাছে ছিল আরটিএম কার্ড, আর দেখছিলেন সানরাইজার্স হায়দরাবাদ। যাহোক, বেঙ্গালুরু পেছনে সরে গেলে মনে হচ্ছিল পন্ত ১১.২৫ কোটি রুপিতেই লক্ষ্ণৌ-এর দলে ভিড়তে যাচ্ছেন। কিন্তু হঠাৎই পন্তের জন্য ১১.৫০ কোটি রুপি দর হাকেন হায়দরাবাদের মালিক কাব্য মারান। এই সময় হায়দরাবাদ আর লক্ষ্ণৌ-এর মধ্যে উত্তেজনাপূর্ণ নিলাম যুদ্ধ চলতে থাকে। চারদিকে অডিয়েন্সের করতালির আওয়াজে নিলামদারের কথা অস্পষ্ট হয়ে যায়। একপর্যায়ে হায়দরাবাদের ২০ কোটি রুপি ঘোষণার বিপরীতে লক্ষ্ণৌ ২০.৭৫ কোটি দর হাকে। এরপর হায়দরাবাদ আর নতুন করে কোনো দর ঘোষণা করে না। এই পর্যায়ে দিল্লি তাদের আরটিএম কার্ড ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু লক্ষ্ণৌ তখন সব রেকর্ড ভেঙে দিয়ে ২৭ কোটি রুপি ঘোষণা করে। নিলামে ফ্র্যাঞ্চাইজিদের এই লড়াইটা যেকোনো সিনেমার উত্তেজনাকেও হার মানায়।
আইপিএলকে এই নিলাম প্রক্রিয়াটাই অন্যান্য ক্রিকেট লিগ থেকে আলাদা করেছে। এখানে খেলোয়াড় নির্বাচন করার জন্য নিলাম যুদ্ধের মাধ্যমে খেলোয়াড়ের দাম নির্ধারণ করা হয়। আর অন্যান্য লিগগুলোতে ড্রাফটের মাধ্যমে খেলোয়াড় নির্বাচন এবং দাম নির্ধারণ করা হয়। সুনির্দিষ্ট সংখ্যক খেলোয়াড়দের বিভিন্ন বিভাগে ভাগ করা হয়। বিভাগগুলোর জন্য দামের একটা পরিসীমা নির্ধারণ করে দেওয়া থাকে। বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো নির্দিষ্ট ওই পরিসীমা থেকে খেলোয়াড়দের জন্য দাম নির্ধারণ করে। আর এজন্যই আইপিএল বাদে অন্যান্য লিগ খেলাগুলোতে আমরা ‘দামি খেলোয়াড়’ শিরোনামের পরিবর্তে ‘ড্রাফটে সর্বোচ্চ দামি খেলোয়াড়’, ‘সর্বোচ্চ দামি ক্যাটাগরিতে খেলোয়াড়’, কিংবা ‘ ‘ড্রাফটে সবচেয়ে দামি ক্যাটাগরিতে খেলোয়াড়’- এই ধরনের শিরোনামের সংবাদগুলো দেখি।
এবার দেখা যাক, নিলাম-পূর্ববর্তী ঘটনাগুলো। এবারের সর্বোচ্চ দামি খেলোয়াড় পন্তের গল্পটা আমরা আলোচনা করছিলাম। আইপিএলের নিলামের নিয়ম ‘আরটিএম’-এর জন্যই পন্ত আইপিএলের ইতিহাসে সবচেয়ে দামি খেলোয়াড় হয়েছেন। এমনটা যে হবে এটা অনেকেই আগে থেকে অনুমান করেছিলেন। অনুমান করেছিলেন পন্ত নিজেও। কারণ খেলোয়াড় হিসেবে তিনি একজন উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান, যার নেতৃত্ব দেওয়ার মতো সক্ষমতাও আছে। বিভিন্ন দলের প্রয়োজন বিবেচনায় এই মৌসুমে বেশ কয়েকটি দলের এমন বৈশিষ্ট্যের খেলোয়াড় প্রয়োজন ছিল। আর এই বিশ্লেষণটা পন্ত ভালোভাবেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। সাথে বাজারের একটা চাহিদাও ছিল। ভয়াবহ একটা দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে, পুনরায় ক্রিকেটে ফিরে আসায় ক্রিকেটপ্রেমিদের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা অধিক মাত্রায় বৃদ্ধি পায়। আর বাজার এই আবেগটাকেই ধরতে চেয়েছিল। এজন্যই দিল্লি তাকে রিটেন করতে চাইলেও তিনি সামাজিক মিডিয়া এক্সে আচমকাই মধ্যরাতে পোস্ট দিয়েছিলেন, ‘নিলামে যদি আমার নাম ওঠে, আমি কি বিক্রি হবো, নাকি অবিক্রিত থেকে যাব? হলে কত মূল্যে?’
লক্ষ্ণৌ তাদের উইকেট-কিপার ব্যাটসম্যান এবং অধিনায়ক লোকেশ রাহুলকে রিলিজ করেছিল। যদিও আরটিএম কার্ড ব্যবহার করে তারা তাকে রিটেন করতে পারতো। কিন্তু রাহুলের সেখানে আবার ফিরে যাওয়ার কোনো কারণ ছিল না। গত মৌসুমে তার আর লক্ষ্ণৌর মালিক সঞ্জীব গোয়েঙ্কার বিবাদের ঘটনাটা অনেকেই জানেন। ভারতীয় ক্রিকেট মহলে বিতর্কিত অধ্যায় হিসেবে থেকে যাবে ১৭তম আইপিএলে রাহুল ও গোয়েঙ্কার সেই বিবাদ। গত মৌসুমে লক্ষ্ণৌ হায়দরাবাদের কাছে এক ম্যাচ হেরে যাওয়ার পর মাঠে প্রকাশ্যে রাহুলকে ভর্ৎসনা করেছিলেন দলের মালিক গোয়েঙ্কা। এমনকি লক্ষ্ণৌর দলের মালিক রাহুলের সাথে উত্তপ্ত কথোপকথন ক্যামেরায় ধরাও পড়েছিল। আর এটা দ্রুতই ভক্ত এবং ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের মধ্যে একটি চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছিল। এই ঘটনাটা লক্ষ্ণৌর ইমেজকে অনেকটাই খারাপ করে ফেলেছিল। এজন্য লক্ষ্ণৌও অডিয়েন্সের ঐ আবেগকে জিততে চেয়েছিল।
রাহুল দল থেকে চলে যাওয়ার পর লক্ষ্ণৌর দরকার ছিল এমন একজন উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান, যার নেতৃত্ব দেওয়ার মতো সক্ষমতা আছে। এক্ষেত্রে পছন্দের শীর্ষে ছিল পন্ত, রাহুল আর জস বাটলার। তবে রাহুলের ফেরার সম্ভাবনা না থাকার কারণে পন্ত, আর বাটলার ছিল তাদের অপশন। কিন্তু লক্ষ্ণৌর প্রয়োজন ছিল এমন একজন মার্কি খেলোয়াড় যার মাধ্যমে ফ্র্যাঞ্চাইজির ইমেজ উন্নত হবে এবং ব্যবসায়িক দিক দিয়েও লাভবান হওয়া যাবে। সুতরাং পন্ত ছাড়া লক্ষ্ণৌ-এর কাছে আর কোনো বিকল্প ছিল না। আর নিলামে আসার আগে থেকেই এটাই ছিল তাদের পরিকল্পনা। এজন্য ৬৯ কোটি রুপি নিয়ে নিলামে আসা এই ফ্র্যাঞ্চাইজি দিল্লির আরটিএম কার্ড ব্যবহারের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে হায়দরাবাদের ডাকা ২০. ৭৫ কোটি থেকে এক লাফে ২৭ কোটি রুপিতে চলে যাওয়াটা বিস্ময়কর কোনো বিষয়ই ছিল না!
লক্ষ্ণৌ-এর কর্ণধার গোয়েঙ্কা বলছিলেন ‘এটা শুধু একজন ব্যক্তিগত খেলোয়াড়ের বিষয় ছিল না।... আমরা কি সবচেয়ে দামি খেলোয়াড় কিনতে চেয়েছিলাম? না, সেটাও নয়। দিনের শেষে, এটি ফ্র্যাঞ্চাইজির কাছে খুব একটা বড় বিষয় নয়। ... আমি আশা করছি, তাকে এলএসজির অংশ হিসেবে দেখে ভক্তরা নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে।’
গোয়েঙ্কা যথার্থই বলেছিলেন, এটা শুধু একজন ব্যক্তিগত খেলোয়াড়ের বিষয় ছিল না। কারণ তারা ২৭ কোটি রুপির বিনিময়ে শুধু একজন খেলোয়াড়কেই কেনেননি। তারা কিনেছেন ফ্র্যাঞ্চাইজির ইমেজকেও। মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে বাজার ধরে রাখতে এটার কোনো বিকল্প ছিল না। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে পুনরায় ক্রিকেট মাঠে ফিরে আসলে সারা বছর ধরে পন্তকে কেন্দ্র করে মিডিয়ার আবেগঘন সংবাদ, ফিচার, তাকে ঘিরে বিভিন্ন তারকাদের বক্তব্যের কারণে তাকে কেন্দ্র করে একটা বিশাল বাজার তৈরি হয়ে যায়। অন্যদিকে, ফ্র্যাঞ্চাইজিদের দলের সৃষ্ট প্রয়োজন বা ফাঁকা জায়গা বিবেচনায় এটা বোঝা খুবই সহজ যে এই আসরে পন্ত-ই ছিলেন সেই চিত্রনাট্যের তারকা, সবচেয়ে ‘দামি খেলোয়াড়’। কিন্তু আইপিএলের ক্রিকেট আসরে এই দামি খেলোয়াড়রা যে সবসময় সবচেয়ে ভালো পারফর্ম করতে পারেন, কিংবা করেছেন- এমনটা মোটেও না। বরং সর্বশেষ কয়েকটা আসর বিবেচনায় নিয়ে দেখা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু এটা নিয়ে সেই নির্দিষ্ট ফ্র্যাঞ্চাইজির কোনো আফসোসও দেখা যায়নি কখনোই! কারণটা খুবই স্পষ্ট। যে বাজারকে ধরতে তারা এই বিশাল অংক খরচ করেছিলেন, বা করেন, সেটা তারা বিশাল অংকের মুনাফা সমেত ফিরে পান।
৭৪ ম্যাচের দীর্ঘ দুই মাসের ক্রিকেট আসরকে কেন্দ্রে রেখে টুর্নামেন্ট শুরু হওয়ার আগে থেকেই এতো আয়োজন, জাঁকজমকপূর্ণ নিলাম প্রক্রিয়া, নিলামের অভিনব কায়দা- কানুন- সবটাই সাজানো হয় এই ‘দামি খেলোয়াড়’-এর কনসেপ্টকে ঘিরে। অর্থাৎ এটা খুবই সহজবোধ্য যে, মিডিয়ার মুনাফা অর্জনের জন্য ‘দামি খেলোয়াড়’ তকমা মিডিয়া-সৃষ্ট একটা ন্যারেটিভ।
লেখক পরিচিত:
বর্তমানে কর্মরত আছেন জাতীয় দৈনিক দ্য ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস-এ জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক হিসেবে। স্নাতকোত্তর ও স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে। তার আগ্রহের জায়গা হলো জেনারেশন-মিডিয়া রিলেশনশিপ, মিডিয়া-স্পোর্টস আন্তঃসম্পর্ক, সামাজিক মিডিয়া এবং সংবাদ কনসেপ্ট নিয়ে। লেখকের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ইমেইল করুন এই ঠিকানায়: jannatulruhi@gmail.com
Disclaimer: The views expressed in this article are the author's own and do not necessarily reflect The Insighta's editorial stance. However, any errors in the stated facts or figures may be corrected if supported by verifiable evidence.
দারুণ ব্যাখ্যা বন্ধু
দারুণ ব্যাখ্যা বন্ধু