তারেক রহমানের সাক্ষাৎকার: একটি জনগণকেন্দ্রিক বয়ান
বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তারেক রহমান নিজেকে ‘নির্বাসিত নেতা’ নয়, বরং জনগণকেন্দ্রিক রাজনীতির প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপন করেছেন; কৌশল ও নৈতিকতার সমন্বয়ে তিনি বিএনপির পুনর্জাগরণের বয়ান গড়ছেন।
Tarique Rahman did not reveal any new political plans in his interview with BBC Bangla. Rather, it was a narrative reconstruction– an attempt to reestablish himself from an “exiled leader” to a “representative of democracy-seeking people.” I believe this “people-centered narrative” by Tarique Rahman may inspire new hope within Bangladeshi politics.
বিবিসি বাংলার সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে (প্রথম পর্ব) বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্য ছিল একাধারে জনগণকেন্দ্রিক, কৌশলগত ও প্রতীকী। দীর্ঘ সতেরো বছর নির্বাসনে থাকা এই নেতা সাক্ষাৎকারের শুরুতেই বলেন, “ফিজিক্যালি আমি এই দেশে আছি, কিন্তু মন মানসিকতায় আমি বাংলাদেশেই রয়ে গেছি।” এটি কেবল নস্টালজিয়ার প্রকাশ নয়; বরং একটি পরিশীলিত রাজনৈতিক যোগাযোগ কৌশল। এখানে ‘সিম্বলিক প্রেজেন্স’-এর এক রূপ ফুটে উঠেছে– যেখানে শারীরিক অনুপস্থিতি সত্ত্বেও নেতৃত্বের মানসিক উপস্থিতিকে রাজনৈতিক বৈধতার অংশ হিসেবে তুলে ধরা হয়। দীর্ঘ প্রায় দুই দশক পর গণমাধ্যমে দেয়া প্রথম এই সাক্ষাৎকারের শুরুতে জনাব রহমান সেটিই করেছেন।
প্রথম পর্বে ৪৫ মিনিট ব্যাপ্তির সাক্ষাৎকারের পুরোটা জুড়ে তারেক রহমান এমন একটি বয়ান নির্মাণ করেছেন, যেখানে তিনি ‘জুলাই অভ্যুত্থান’-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র হলেও নিজেকে ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে দাবি করেননি। বরং তিনি আন্দোলনের কৃতিত্ব জনগণের হাতে ফিরিয়ে দিয়েছেন। ‘এই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ’-- এই বক্তব্যটি শুধু বিনয় নয়; এটি রাজনৈতিক পুনর্নির্মাণের কৌশল। এর মাধ্যমে তিনি বিএনপিকে জনগণনির্ভর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ধারক হিসেবে পুনঃস্থাপন করতে চেয়েছেন। রাজনৈতিক যোগাযোগের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি একটি কালেক্টিভ ফ্রেমিং তৈরি করে– যেখানে আন্দোলনের কৃতিত্ব ব্যক্তি বা দলের নয়, বরং জনগণের সম্মিলিত প্রতিরোধের ফল। অথচ জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে যেসব গবেষণা হয়েছে সেখানে তারেক রহমান ও বিএনপির ভুমিকাই যে মূখ্য ছিলো তার প্রমাণ মিলেছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময়ে #StepDownHasina নিয়ে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, আন্দোলন চলাকালীন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চার ধরণের মেডিয়েটর হাসিনা পতনের আন্দোলন ত্বরান্বিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো। এদের মধ্যে ব্যক্তি ও রাজনৈতিক পর্যায়ের মেডিয়েটর যেমন ছিলো তেমনি অরাজনৈতিক গোষ্ঠী পর্যায়ের মেডিয়েটর এবং মিডিয়া পর্যায়ের মেডিয়েটর ছিলো। ব্যক্তিপর্যায়ের মেডিয়েটরদের উপস্থিতি অধিক পরিমাণে দেখা গেলেও রাজনৈতিক পর্যায়ের মেডিয়েটরদের কন্টেন্ট উৎপাদন ও এক্টিভিজমের পরিমাণ ছিল ব্যক্তিপর্যায়ের মেডিয়েটরদের প্রায় দ্বিগুণ। এসব রাজনীতি সংশ্লিষ্ট মেডিয়েটরদের মধ্যে তারেক রহমান ও তাঁর আশেপাশের মেডিয়েটরদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। তবে এই সাক্ষাৎকারে তিনি জুলাই অভ্যুত্থানের পুরো কৃতিত্ত্ব জনগনকে দিয়েছেন। একে বলা যায় ‘ডেমোক্রেটাইজেশন অব ক্রেডিট’ যার মাধ্যমে আন্দোলনের নেতৃত্বের বৈধতা জনগণের হাতে হস্তান্তরের মাধ্যমে রাজনৈতিক বৈধতা অর্জনের চেষ্টা করেছেন।
জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে তারেক রহমানের বক্তব্য ছিল কূটনৈতিক ও হিসাবি। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “যারা দেশের আইন-কানুন মেনে রাজনীতি করবে, তাদের রাজনীতি করার অধিকার আছে।” এই বক্তব্য দ্ব্যর্থপূর্ণ হলেও রাজনৈতিকভাবে তা বুদ্ধিদীপ্ত। একদিকে তিনি জামায়াতকে সরাসরি সমর্থন জানাননি। অন্যদিকে তিনি জামায়াতের সঙ্গে সম্ভাব্য আলোচনার পথ খোলা রাখছেন। আওয়ামী লীগ শাসনামলে দলটির নেতাকর্মীরা যেমনটি কথায় কথায় বিভিন্ন দলকে জঙ্গী তকমা দিতেন জনাব রহমান সেদিকে হাঁটেননি। এমনকি ৯-১১ পরবর্তী সময়ে যেকোনো ইসলামি দলকে জঙ্গী তকমা দেয়ার যে অলিখিত প্রচার-প্রচারণা শুরু হয়েছিলো সেদিকেও তিনি হাঁটেননি। এর মাধ্যমে বিএনপি পুনরায় “বহুদলীয় গণতন্ত্র”-এর ধারণাকে ব্যবহার করছে ক্ষমতা প্রত্যাবর্তনের যৌক্তিক হাতিয়ার হিসেবে।
আর আওয়ামী লীগের রাজনীতি প্রশ্নে তারেক রহমানের অবস্থান আরও স্পষ্ট। সাক্ষাৎকারের শেষ দিকে তারেক রহমান বলেন, “জনগণ যদি সমর্থন না করে কোনও দলকে, তাদের টিকে থাকার কারণ দেখি না।” এখানে তিনি রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞার বদলে জনগণের রায়ের উপর নির্ভর করার কথা বলেছেন– যা গণতান্ত্রিকভাবে সঠিক। তবে একই সাথে “যে দল মানুষ খুন করে, লুট করে, গুম করে তাদের টিকে থাকার কারণ দেখি না”-- এই ভাষ্য আবারও নৈতিকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বী দলকে অবৈধ করে তোলে। আর আওয়ামী লীগের বিচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “দল হিসেবে তারা যদি অন্যায় করে থাকে তাহলে দেশের আইন অনুযায়ী তার বিচার হবে। দেশের আইন সিদ্ধান্ত নেবে।” আওয়ামী লীগের রাজনীতি এবং বিচার তিনি জনগণ এবং দেশের প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার হাতে ছেড়ে দিয়েছেন।
সাক্ষাৎকারে বিএনপি নিয়ে তারেক রহমান বেশ কিছু বিষয় খোলাসা করেছেন। সাক্ষাৎকারের তারেক রহমান ২০০১–২০০৬ সালের বিএনপি ও বর্তমান বিএনপির মধ্যে পার্থক্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন– প্রযুক্তি, সামাজিক মাধ্যম এবং কোভিড-পরবর্তী সমাজবোধ রাজনীতির গতি-প্রকৃতি পাল্টে দিয়েছে। এর অসংখ্য উদাহরণ আমরা জনাব রহমানের সাম্প্রতিক কর্মকান্ডে দেখেছি। বিশেষ করে দেশের সংখ্যালঘু নির্যাতন থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী যেমনটি চার্লি কার্কের হত্যাকান্ড, গাজা ইস্যুসহ বিভিন্ন বিষয় তিনি যেভাবে ডিল করেছেন তাতে বলা যায় বিএনপি পরিবর্তনের পথে আছে। কিন্তু সেই পরিবর্তনের পথে হাঁটতে গিয়ে তার মূল রাজনৈতিক দর্শন বা নীতি থেকে পিছপা হয়নি। যেমনটি তিনি বলেছেন, বিএনপি “মানুষের বেটারমেন্ট” এর জন্য কাজ করে। এই উন্নয়নমূলক বয়ানই তিনি পুনরাবৃত্তি করেছেন যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে খুবই জরুরি।
বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও দখলের অভিযোগে তারেক রহমানের প্রতিক্রিয়া ছিল দ্বিমুখী। একদিকে তিনি স্বীকার করেছেন যে “কিছু ঘটনা ঘটেছে,” এবং দলীয়ভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতাকে দায়ী করেছেন। এটাও ঠিক ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে পুলিশবাহিনী দেশের আইন-শৃংখলা রক্ষায় বিভিন্নক্ষেত্রে অক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বার্তা নিহিত। বিএনপি নিজেদের ‘নৈতিকতাপূর্ণ সংগঠন’ হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়, অথচ দায়ভার স্থানান্তর করছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দিকে। এটি একটি রাজনৈতিক প্রচারণার কৌশল– যা জনবিশ্বাস পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা হলেও বাস্তবে দায়মুক্তির ভাষ্য গড়ে তোলে। বিএনপিকে এই ব্যাপারে আরও সিরিয়াস হতে হবে। বিশেষ করে ইউনিয়ন ও থানা পর্যায়ে বিএনপি নেতা-কর্মীদের কর্মকান্ডে দলটি জনসমর্থন হারাচ্ছে।
তারেক রহমানের এই সাক্ষাৎকারে নতুন কোনো রাজনৈতিক পরিকল্পনা উন্মোচিত হয়নি। বরং এটি ছিল একটি বয়ানগত পুনর্গঠন– যেখানে তিনি নিজেকে ‘নির্বাসিত নেতা’ থেকে ‘গণতন্ত্রকামী জনগণের প্রতিনিধি’ হিসেবে পুনঃস্থাপন করতে চেয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার চক্রে তারেক রহমানের এই ‘জনগণকেন্দ্রিক বয়ান’ নতুন আশা জাগালেও, সেটি বাস্তব রূপ পাবে কি-না, তা নির্ভর করবে তাঁর প্রতিশ্রুত ‘প্রত্যাবর্তন’ সত্যিকার অর্থে কখন এবং কীভাবে ঘটে এবং বিএনপির নেতাকর্মীরা তারেক রহমানের এই বার্তা কতটা ধারণ করতে পারেন, তার উপর। তাঁর এই সাক্ষাৎকার বিএনপির পুনর্বাসন প্রচেষ্টার এক অংশ– যেখানে তিনি জনগণকেন্দ্রিক রাজনীতি ও নৈতিকতা– এই দুই উপাদান মিশিয়ে “নতুন রাজনীতি”-র আভাস দিতে চেয়েছেন।
About the Author:
Zahed Arman is an Associate Editor for Politics and Governance at The Insighta. He is also an Assistant Professor of Political Communication at Mississippi State University. His research focuses on political campaigns, voter behavior, and social media analytics. He can be reached at za231@msstate.edu
Disclaimer: The views expressed in this article are the author’s own and do not necessarily reflect The Insighta’s editorial stance. However, any errors in the stated facts or figures may be corrected if supported by verifiable evidence.